আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হল 'আর্কাইভ অফ কমিউনিটি হেরিটেজ' , পারিবারিক ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী- স্থান পেল সব...
আজকাল | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: চন্দননগর কলেজে ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল ৬ই অক্টোবর ২০২৩, চন্দননগর কলেজ মিউজিয়ামের উদ্বোধনের মাধ্যমে। বিপ্লবীদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সেই মিউজিয়াম ইতিমধ্যেই শহরের স্মৃতি-সংরক্ষণের এক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতাকে আরও বিস্তৃত করে, শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ বিকেল ৩টায় কলেজের হেরিটেজ বিল্ডিং-এর অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হল 'আর্কাইভ অফ কমিউনিটি হেরিটেজ' |
এই আর্কাইভে স্থান পেয়েছে চন্দননগরের নানান পরিবার থেকে সযত্নে সংগৃহীত ঐতিহ্যবাহী দ্রব্যসামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে যদু ঘোষের রথের অংশ, ঔপনিবেশিক সংগ্রহশালার বহুমূল্য স্মারক, সময় গণনার যন্ত্র, বিপ্লবীদের স্মারকচিহ্ন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নিদর্শন, বিদ্যুতের বিবর্তনকে চিহ্নিত করে প্রাচীন বৈদ্যুতিক ও আলোকসজ্জার উপকরণ, ঔপনিবেশিক আমলের দুর্লভ বাদ্যযন্ত্র, ফরাসি আমলের দলিলপত্র, প্রাচীন মুদ্রা, পুরোনো সংবাদপত্র, ইত্যাদি। প্রতিটি দ্রব্যই নান্দনিক যত্নে সংরক্ষিত হয়েছে, যাতে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে ওঠে।
বিশেষ সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে এক ঐতিহাসিক ঘোড়ার গাড়ি, যা একসময় ব্যবহার করতেন চন্দননগরের কৃতী সন্তান বাবু দুর্গা চরণ রক্ষিত | ফরাসি সরকার তাঁকে সম্মান জানিয়ে ‘রাজা’ উপাধি ও Chevalier of Legion of Honour খেতাব প্রদান করেছিল। ১৮৮০ সালে তিনি এই ‘পালকি গাড়ি’ ক্রয় করেন, যা দীর্ঘ সময় ধরে কলকাতার রাস্তায় চলেছে - হাওড়া স্টেশন থেকে তাঁর অফিস (১, ওল্ড কোর্ট হাউস লেন) পর্যন্ত। পরবর্তীকালে এই গাড়ি স্থানান্তরিত হয় তাঁর চন্দননগরের আবাসে। আজ তাঁর পঞ্চম প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা এই বিরল ঐতিহাসিক নিদর্শনটি চন্দননগর কলেজের হাতে তুলে দিয়েছেন।
চন্দননগরের বিভিন্ন পরিবার থেকে এই সকল অমূল্য দ্রব্যাদি সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন চন্দননগর কলেজ প্রাক্তনী সমিতির সভ্যবৃন্দ। তাঁদের উদ্যোগেই শহরের ঘরোয়া ঐতিহ্য প্রথমবারের মতো একত্রে সঞ্চিত হয়েছে। সংগ্রহকৃত দ্রব্যসামগ্রীর পুনর্গঠন ও সংরক্ষণের সূক্ষ্ম কাজ অক্লান্ত নিষ্ঠা ও নান্দনিক দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন প্রখ্যাত সিরামিক শিল্পী ও ভাস্কর শ্রী সন্দীপ পাল, এবং জাতীয়-পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী শ্রী কিঙ্কর ঘোষ। প্রতিটি দ্রব্যসামগ্রীর অন্তর্নিহিত গল্পও সমান যত্নে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপিকা শ্রীমতি সুজাতা দাস এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা শ্রীমতি চন্দনা ব্যানার্জি এই বর্ণনাগুলি সুনিপুণভাবে লিখে সংরক্ষণ করেছেন। তাঁদের এই প্রয়াসে অপরিসীম সহায়তা প্রদান করেছেন কলেজেরই অত্যন্ত সক্রিয় প্রাক্তন ছাত্র রাজদীপ সোম। কলেজের অধ্যক্ষ শ্রী দেবাশীষ সরকার এবং প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সম্পাদক শ্রী দীপ্তনারায়ণ মুখোপাধ্যায় জানান, 'এই আর্কাইভ কেবল ইতিহাসের নিদর্শন সংরক্ষণের ভাণ্ডার নয়, বরং গবেষণা, শিক্ষা ও নাগরিক গর্বের এক মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠবে। শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রজন্মান্তরের উত্তরাধিকার এই আর্কাইভে সযত্নে রক্ষিত থাকবে, যা আগামী দিনে চন্দননগরের আত্মপরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।'
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেইসব পরিবারের বিশিষ্ট সদস্যবৃন্দ, যাঁরা তাঁদের অমূল্য সংগ্রহ কলেজের হাতে সমর্পণ করে এই উদ্যোগকে সমৃদ্ধ করেছেন। সঙ্গে ছিলেন কলেজের প্রাক্তনী সমিতির সদস্যবৃন্দ, শিক্ষক–শিক্ষিকা ও শিক্ষা-সহায়ক কর্মীরা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, চন্দননগরের মাননীয় মেয়র ও ডেপুটি মেয়রের সৌজন্যমূলক উপস্থিতি এই দিনটিকে আরও গৌরবান্বিত করেছে। তাদের সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এই উদ্বোধন শুধু একটি অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রইল না, বরং চন্দননগরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের ইতিহাসে এক স্থায়ী মাইলফলক হয়ে রইল |