• রাত পোহালেই মহালয়া, ৬৯ বছরের বৃদ্ধের হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পাচ্ছে গ্রামোফোন, রেডিও
    বর্তমান | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ব্রতীন দাস, জলপাইগুড়ি: রাত পোহালেই মহালয়া। ৬৯ বছরের বৃদ্ধের হাতের ছোঁয়ায় ‘প্রাণ’ ফিরে পাচ্ছে গ্রামোফোন, রেডিও। গত কয়েকদিন ধরেই নাওয়াখাওয়ার ফুরসত পাচ্ছেন না জলপাইগুড়ির গৌতম দাশ। শহরের কদমতলায় সারাবছর তাঁর দোকান কার্যত ‘গড়ের মাঠ’ হয়ে থাকলেও এসময়ে কদর বাড়ে এই রেডিও মিস্ত্রির। 

    বাবা ননীগোপাল দাশ, জলপাইগুড়ি শহরের প্রথম রেডিও মিস্ত্রি ছিলেন। তাঁর কাছেই রেডিও সারানো শেখা গৌতমবাবুর। স্কুলে পড়তে পড়তেই রেডিও সারানো শুরু করেন। কথায় কথায় বললেন, প্রথমে রেডিওতে ছিল ভাল্ভ সেট। পরে এল সিলিকন ট্রানজিস্টর। এখন আইসি। বাবার কাছেই গ্রামোফোন সারানো শিখেছি। এখনও অনেকেই মহালয়ার আগে গ্রামোফোন সারাতে নিয়ে আসেন। যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনাতে হয়। সময় লাগে। তবে এবারও শিলিগুড়ি থেকে আমার কাছে গ্রামোফোন সারানোর জন্য এসেছিল। কলকাতা থেকে যন্ত্রাংশ আনিয়ে সেটি সচল করে দিয়েছি। তাছাড়া মহালয়ার আগে বহু পুরনো রেডিও সারাতেও আসছেন অনেকে। 

    প্রায় ৪৫ বছর ধরে রেডিও সারাই করে চলেছেন গৌতমবাবু। বললেন, ষাটের দশকে ভাল্ভ রেডিওর প্রচলন ছিল। যাঁর বাড়িতে ওই রেডিও থাকত, গোটা পাড়ার ভিড় জমত সেখানে। সেসময় রেডিও যেমন কম ছিল, রেডিও সারাইয়ের মিস্ত্রিও সেভাবে ছিল না জলপাইগুড়িতে। বাবা হাতে ধরে কয়েকজনকে রেডিও সারানো শিখিয়েছিলেন। পড়াশোনার ফাঁকে আমিও বাবার কাছ থেকেই অচল রেডিওর প্রাণ ফেরানোর বিদ্যে শিখেছি। রেডিও’র যে সমস্যাই হোক না কেন, আজ পর্যন্ত তা সারাতে ব্যর্থ হইনি।  

    শুক্রবার গৌতমবাবুর দোকানে রেডিও সারাই করতে এসেছিলেন জলপাইগুড়ি শহরের মহামায়াপাড়ার বাসিন্দা ৭০ বছরের বিশ্বনাথ রায়। অবসরপ্রাপ্ত ওই সরকারি কর্মী বলেন, ৬০ বছর আগে আমাদের বাড়িতে প্রথম রেডিও আসে। দাদা গণেশচন্দ্র রায় সেটি কিনেছিলেন। গোটা পাড়ার লোক আমাদের বাড়িতে ওই রেডিও শুনতে আসত। ’৬৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় রেডিওটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমরা রেডিও শোনার অভ্যাস ছাড়তে পারিনি। তাঁর কথায়, ক’দিন রেডিওতে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। ভাবলাম, মহালয়ার ভোরে যদি বিগড়ে যায়! তাই সেটি সারাই করতে এসেছি। 

    গৌতমবাবুর দোকানেই রেডিও সারানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন জলপাইগুড়ির বউবাজারের বাসিন্দা আয়কর দপ্তরের কর্মী মনোজ ভট্টাচার্য। বললেন, বাড়িতে আমার ৭৮ বছরের মা। তাঁর রেডিও না শুনলে ঘুম আসে না। এখনও দৃষ্টিশক্তি ভালোই। কিন্তু টিভিতে মন বসে না মায়ের। মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী শুনবে বলে মা জোর করে রেডিওটা একবার মিস্ত্রিকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে বলল, তাই এসেছি। 

    প্রবীণদের পাশাপাশি মহালয়ার প্রাক্কালে রেডিও সারাইয়ের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেল নতুন প্রজন্মের অনেককেও। জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলায় রেডিও সারাইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অরবিন্দনগরের বাসিন্দা তন্ময় কুণ্ডু বললেন, আমি টিউশন পড়াই। বাড়িতে ৭০ বছরের বাবা রয়েছেন। তিনি রেডিও শুনতে খুবই পছন্দ করেন। বেশ কয়েক বছর আগে টিউশন পড়িয়ে পাওয়া টাকা দিয়ে বাবাকে একটা রেডিও কিনে দিয়েছিলাম। মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার ঐতিহ্য আজও অটুট। সেকারণে মাহেন্দ্রক্ষণে রেডিওটা যাতে বিগড়ে না যায়, তাই মিস্ত্রিকে একটু দেখিয়ে নিয়ে গেলাম। 

    (গৌতম দাশ।-নিজস্ব চিত্র)
  • Link to this news (বর্তমান)