• উমার আগমনে খণ্ডঘোষের ভূত বাংলোয় আনন্দ যজ্ঞের আয়োজন, উধাও গা ছমছমে পরিবেশ
    বর্তমান | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সুখেন্দু পাল, খণ্ডঘোষ: বলে আয়রে ছুটে, আয়রে ত্বরা। হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জ্বরা...। মৃত্যুভয়, ভূতপ্রেত, গা ছমছমে ভাব— সব এখন উধাও। উমা আসছেন। খণ্ডঘোষের কামালপুরের ‘ভূত বাংলো’ এখন শুধু আলোয় আলো ভরা! 

    শরতের আকাশ তখন রক্তিম। দিগন্তে ঢলে পড়ছে সূর্য। ক্রমেই আঁধারে ডুব দিচ্ছে কামালপুরের দামোদর পাড়। কিছু দূরে বিশাল জরাজীর্ণ অট্টালিকা। গাছগাছড়া, শিকড়-বাকড়ের আঁকড়ে থাকা স্থাপত্য জানান দেয়—একদা বাড়িটির আভিজাত্য, জৌলুস সবই ছিল। লোকজনের ভিড় ছিল। পেয়াদা,  পাহারাদার সবই ছিল। এখন জীবনহীন থমথমে! ভেঙে পড়ছে এক একটা ঘরের দেওয়াল। সেখানে লকলক করছে আগাছা। তার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা বিষধরদের ফোঁসফাঁস। সন্ধ্যা নামে। রাত গভীর হয়। লোকে বলে, রাত বাড়লে বাড়ির অন্দরমহল থেকে ভেসে আসে নুপুরের শব্দ। গায়ের লোম নাড়িয়ে দেয় সেই আওয়াজ। ফলে, রাতের বেলা তো দূরের কথা, দিনেও বাড়িটির মুখোমুখি হতে বুকের পাট্টা দেখান না স্থানীয় কেউই। সবাই বলেন, ওটা একটা ভুতবাংলো। নিশুতি রাতে ভুতেরা ঘুরে বেড়ায়। বাড়ির ভিতর রয়েছে গোপন সুড়ঙ্গ। তার সঙ্গে সরাসরি যোগ বর্ধমান রাজবাড়ির। রাজ আমলে সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজ দরবারে যাতায়াত ছিল। সেসব এখন নাকি ভূতপ্রেতের দখলে! 

    তবে, পুজোর ক’টা দিনের ছবিটা অন্যরকম। উমার আগমনে ভুতেরা সব নাকি ছেড়েছুড়ে পালায়! গমগম করে ওঠে পোড়ো অট্টালিকা। আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে ‘ভুতবাংলো’। প্রসাদের মধ্যেই দুর্গাদালান। সেটাই একমাত্র আভিজাত্য ধরে রেখেছে। ইংরেজ আমলে এই বাড়ির এক সদস্য দেওয়ান হয়েছিলেন। তিনিই বানিয়েছিলেন অট্টালিকা, দুর্গাদালান। বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের কেউই জীর্ণ প্রাসাদে থাকেন না। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিদেশে। তবে, প্রতি বছর পুজোর ক’টা দিন সকলেই আসেন। উমার আরাধনা হয় প্রাচীন রীতি মেনে। বিজয়া দশমীর পর আবার তাঁরা ফিরে যান যে যাঁর কর্মস্থলে। ফের অন্ধকারে ডুব দেয় ‘ভূত বাংলো’। ফিরে যায় তার পুরনো চেহারায়। 

    কথা হচ্ছিল গ্রামের বাসিন্দা রানাপ্রতাপ সিনহার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘প্রাসাদটি বর্ধমান জেলা ইতিহাসের একটি অধ্যায়। বাড়িটিকে ঘিরে নানা কিংবদন্তী। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বাড়ির সুড়ঙ্গে গুপ্তধন রয়েছে। সেই আশায় অনেকে অভিযানও চালিয়েছিলেন। কিছু মেলেনি। অট্টালিকার পাশেই আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। প্রতি বছর পুজোর আগে চারপাশ পরিষ্কার করা হয়। বছরের বাকি সময় এইভাবেই পড়ে থাকে।’ 

    দেওয়ানের প্রাসাদকে ঘিরে ভুতপ্রেতের মিথও কম নেই। রানাবাবু অবশ্য বলছিলেন, ‘সেসব কোনও দিনই দেখা যায়নি। সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়। কোনও কোনও সময় অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। প্রথমে বর্ধমানের কিছু মানুষ বাড়িটিকে ‘ভূত বাংলো’ বলে প্রচার করে। তারপর থেকে মুখেমুখে সেই তকমা ছড়িয়ে পড়ে। বোধন থেকেই প্রাসাদের ছবিটা বদলে যায়। ঢাকের আওয়াজ আর শুদ্ধ মন্ত্রচ্চারণে এক অন্য রকম অনুভূতি তৈরি হয়।’ আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা পুজো দেখতে ভিড় করেন। পরিবারের সদস্যরা এখনও জাঁকজমক করে পুজো করেন। আনন্দ আয়োজনের প্রস্তুতি এখন শেষের পর্যায়ে। আর ক’দিন পর চলে আসবেন দেওয়ানের বর্তমান বংশধররা। আসার দিন গুণছে ‘ভূত বাংলো’। 

    কামালপুরের দামোদরের পাড় তখন দেখবে—আলোয় আলো আকাশ! 
  • Link to this news (বর্তমান)