নিজস্ব প্রতিনিধি, জলপাইগুড়ি: সুদিন ফিরবে। এই আশাতেই উমার আরাধনা হয় বন্ধ চা বাগানে। সারাবছর সরকারি সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি পুজোর অনুদান দেয় রাজ্য। সেই অর্থেই মা দুর্গার আবাহনে মাতেন জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকরা। বারবার মালিক বদলেছে এই চা বাগানে। ঘনিয়েছে সঙ্কটের মেঘ। অনিশ্চিত হয়েছে শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ। শেষমেশ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পুরোপুরি বন্ধ রায়পুর চা বাগানটি। খাতায়কলমে একসময় বাগানে ৬১৭ জন শ্রমিক ছিলেন। কমতে কমতে এখন তিনশোজনও বাগানে নেই। পেটের জ্বালায় বাকিরা বাইরে কাজে চলে গিয়েছেন। বাধ্য হয়ে যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, কো-অপারেটিভ গড়ে কোনওমতে বাগান চালাচ্ছেন তাঁরা। নিজেরাই পাতা তুলে দেন। শিলিগুড়ির এক মালিক এসে ওই কাঁচা পাতা নিয়ে যান। বিনিময়ে ১৮০ টাকা হাজিরা পান শ্রমিকরা। ওই টাকায় কোনওমতে দিন গুজরান হয় তাঁদের। বাকিটা রাজ্য সরকারের দেওয়া সহায়তা ভরসা। চরম অর্থসঙ্কট। কিন্তু তারমধ্যেও বাগানে দুর্গাপুজো চালিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। তাঁদের বিশ্বাস, দেবী দশভুজার আশীর্বাদেই একদিন ফের বাগান খুলবে। বাগানের ফ্যাক্টরি লাইনে সকাল হলে বেজে উঠবে সাইরেন। দল বেঁধে কাজে যাবেন শ্রমিকরা। হাসি ফুটবে মহল্লায়। ফিরবে সুদিন। রায়পুর চা বাগানে এবারও প্যান্ডেল হয়েছে। পাতকাটা কলোনির পালপাড়ায় তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। বাগানের শ্রমিক বিশু সাওয়াশি বলেন, আমাদের ঘরে যত অভাবই থাকুক না কেন, মা দুর্গার পুজো বন্ধ হতে দেব না। মায়ের আশীর্বাদ আছে বলেই এখনও বাগানে পাতা মিলছে। সেই পাতা বিক্রি করে কিছুটা হলেও অর্থ হাতে আসছে। আমাদের বিশ্বাস, দেবী দুর্গার আশীর্বাদেই আমাদের বাগান খুলবে। তাঁর কথায়, পুজোর জন্য রাজ্যের তরফে অনুদান মেলে। এছাড়া শ্রমিকরা পাতা বিক্রি করে যে হাজিরা পান, পুজোর চাঁদা হিসেবে একদিনের হাজিরা দেন। সবটা মিলিয়েই পুজো হয়। কিন্তু আক্ষেপ একটাই, বাগানে মা দুর্গা এলেও ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না।রাজ্য সরকার পাশে না দাঁড়ালে তাঁদের যে কী অবস্থা হতো তা ভেবে পান না বাগানের আর এক শ্রমিক মাংরা সাওয়াশি। বললেন, রাজ্য সরকার বিনামূল্যে রেশন দিচ্ছে। প্রতিমাসে দেড় হাজার টাকা করে ফাউলাই পাচ্ছি। বাগান বন্ধ থাকলেও পানীয়জল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা, স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সবেরই ব্যবস্থা করেছে রাজ্য। এখন আমরা শুধু চাই, বাগান খুলে যাক। পেটের তাগিদে যাঁরা বাইরে কাজ করতে গিয়েছেন, ফিরে আসুন তাঁরা। প্রাণ ফিরুক রায়পুর চা বাগানের।কয়েকদিন বাদেই পুজো। ফলে এখন সকাল থেকেই রায়পুর বাগানে শুরু হয়ে যাচ্ছে চা পাতা তোলার কাজ। ওই পাতা তুলে দিতে পারলে মিলবে ১৮০ টাকা হাজিরা। সচল বাগানে পাতা তোলার কাজে নিযুক্ত শ্রমিকরা অবশ্য ২৫০ টাকা হাজিরা পান। নির্ধারিত ওই মজুরির থেকে অবশ্য ৭০ টাকা কম পেলেও মুখ বুজে থাকেন রায়পুরের শ্রমিকরা। কিছুটা হলেও তো মিলছে, এটাই যেন ওদের কাছে অনেক! রায়পুর বাগান থেকে যিনি কাঁচা চা পাতা নেন, শিলিগুড়ির সেই মালিক রাজা দাসের দাবি, সচল বাগানে শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজ করেন। রায়পুরে তো চার ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় না। তাছাড়া বাগানে পাতার গুণমান খারাপ হয়ে আসছে। গোটা বাগান জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল। নিজের গ্যাঁটের টাকা দিয়ে পরিষ্কার করেছি। ২৫০ টাকা মজুরি দিয়ে পাতা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।