• থিমের টানে মেলবন্ধন, পুজো এখন চিন্তনেরও
    আনন্দবাজার | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • দর্শক টানতে চায় সব পুজো। তাই থিম নিখুঁত করতে কদর বাড়ছে গবেষকদের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, গবেষক কৌস্তভ চক্রবর্তী এ বার একাধিক পুজোয় কাজ করেছেন। কাশী বোস লেনে লীলা মজুমদার বা আলিপুর সর্বজনীনে বাঙালির প্রিয় পানীয় চায়ের বিবর্তন— মণ্ডপসজ্জার নেপথ্যের তথ্যানুসন্ধানে যুক্ত থেকেছেন কৌস্তভ। তাঁর মতে, ‘‘পুজোয় তুলে ধরা বিষয় যাতে নিখুঁত ও নির্ভুল হয়, সে জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। পুজো-সম্মানের বিচারক বা আন্তর্জাতিক দর্শকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেও বিশেষজ্ঞদের দরকার।’’

    কৌস্তভ যে শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন, সেই অনির্বাণ দাস এ বছর ছ’টি পুজোর দায়িত্বে। তিনি জানাচ্ছেন, আগে পুজো শিল্পীরা বইপত্র পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রস্তুতি নিতেন। তার পরে আকারে-আয়তনে পুজো যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে পুজোর একটা বৌদ্ধিক স্তরও তৈরি হয়েছে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘শিল্পী হিসেবে আমি গবেষক, বিশেষজ্ঞদের থেকে বিষয়টার পাঠ নিই। শেষ অবধি যে হেতু পুজোয় মূলত দৃশ্যায়নটা গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোন বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হবে, সেটাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হয়ে যায়।’’

    অনির্বাণের সঙ্গে সুরুচি সঙ্ঘের পুজোয় অনুশীলন সমিতি সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করেছেন প্রাক্তন অধ্যাপক সুস্মিতা বসু চক্রবর্তী। দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘের পুজোয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ নিয়ে কাজ করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অগ্নিভ ঘোষ। দক্ষিণদাঁড়ি ইয়ুথস-এ অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করেছেন টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের প্রাক্তনী, গবেষক সায়ন্তনী দত্ত। এ ভাবেই শিল্পীদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে চিন্তক, শিক্ষক, গবেষকদের কাজ। সায়ন্তনীর মতে, ‘‘এতে বৈচিত্র্যেরও চর্চা হচ্ছে। কেবল উদ্‌যাপন নয়, বহু মানুষের সামনে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়কে আনা যাচ্ছে।’’ ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কয়েক বছর আগেই নাকতলা উদয়নের পুজোয় শিল্পী প্রদীপ দাস যে ভাবে একেবারে ওই পাড়ার গড়ে ওঠা, উদ্বাস্তু-জীবনের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তা স্থানীয় ইতিহাস তুলে ধরারই একটা রূপ।

    এখন আবার বহু পুজো কমিটি নিজেদের পুজোর থিম, সেই বিষয়ের ব্যাখ্যা, তত্ত্ব, তথ্য ইত্যাদি নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ করে। ভাবনাকে এমন মুদ্রিত রূপ দেওয়ার জন্যও দরকার পড়ছে বিশেষজ্ঞদের। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অনিতেশ চক্রবর্তী এমন একাধিক পুস্তিকা প্রকাশের কাজ করছেন। তাঁর মতে, ‘‘শিল্পীদের সঙ্গে এ ভাবে নানা ক্ষেত্রের পারদর্শীদের যুক্ত হওয়াটা বিরাট সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করছে।’’ তবে এমন কাজকে ‘গবেষণা’ বলতে আপত্তি রয়েছে ভবতোষ সুতারের। তাঁর কথায়, ‘‘গবেষণা একটা বিরাট ব্যাপার। সারা জীবন লেগে যায় তা করতে। এটা একটা চর্চা, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা, শিল্পীরাও শিখছি।’’

    পুজোর কাজে যুক্ত বিশিষ্টদেরও যে বৌদ্ধিক প্রাপ্তি হচ্ছে, তা মনে করেন শিল্প-ইতিহাসের শিক্ষক দেবদত্ত গুপ্ত। কয়েক বছর ধরেই শিল্পী পার্থ দাশগুপ্তের সঙ্গে তিনি কাজ করছেন গবেষক হিসেবে। এ বছর পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘে কাঠখোদাই ছবির দিকপাল শিল্পী হরেন দাসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যে দেবদত্ত, পার্থ কাজ করছেন একাধিক শিল্পীকে নিয়ে। দেবদত্ত বলছেন, ‘‘শিল্পীর সঙ্গে গবেষক, কথাকার, ক্ষেত্র-সমীক্ষক একাকার হয়ে যাচ্ছেন। পুজো যেমন বদলাচ্ছে, তেমনই এই প্রক্রিয়া বদলে দিচ্ছে শিল্পীকেও।’’ কার্যত দর্শকদের কাছে পৌঁছতে সবাই শিখছেন।

    তবে পুজো-শিল্পের পুরো যাত্রাপথই যে মসৃণ, তা নয়। বড় পুজোগুলি বাদ দিলে বহু শিল্পীকেই আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব, আয়োজকদের হস্তক্ষেপের মতো বহু সমস্যা সামলাতে হয়। সেই সঙ্গেই রয়েছে বাণিজ্য ও শিল্পের টানাপড়েন। তপতী বলছেন, ‘‘এখন যে ভাবে পুজো ঘিরে বিরাট পুঁজি, বিপণন যুক্ত হয়েছে তার বাহ্যিক প্রকাশ কিন্তু পুজোর নান্দনিকতার পুরো বিপরীত। তাই সেই শক্তিগুলি যাতে পুজোর নান্দনিকতাকে গ্রাস করে না ফেলে, তা খেয়াল রাখাও জরুরি।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)