• আবীর বনাম দেব-ও হতে পারে! ‘রক্তবীজ ২’-‘রঘু ডাকাত’ বিতর্ক জিইয়ে রাখলেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ?
    আনন্দবাজার | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • এই প্রথম সাক্ষাৎকারের আগে নিষেধাজ্ঞার তালিকা! “আমরা অকারণ বিতর্ক চাই না। ছবির বাইরে দয়া করে কোনও প্রশ্ন নয়”, প্রায় জোড়হাতে অনুরোধ পরিচালক জুটি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। এত চেষ্টা করেও পুজোর ছবি ‘রক্তবীজ ২’ মুক্তির আগে বিতর্ক এড়াতে পারলেন?

    প্রশ্ন: ২০২৩-এর শারদীয়ায় ‘রক্তবীজ’ জন্ম নিল। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের প্রথম পুজোর ছবি। দুশ্চিন্তায় ঘেমেছিলেন?

    নন্দিতা: আমার কোনও দিন টেনশন হয় না! সেটা পুজো হোক বা অন্য সময়। একটাই বিশ্বাস, আমি যদি ভাল কাজ করে থাকি, যদি ছবি নিজের পছন্দ হয়, তখন আর কিচ্ছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। সেই জায়গা থেকে ২০২৩-এ যখন ‘রক্তবীজ’ এনেছিলাম তখন ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। উইন্ডোজ় প্রযোজনা সংস্থা থ্রিলার আনছে! এত দিন লোকে বলত, এরা থ্রিলার বানাতে পারে না। কোনও দিন এই ঘরানার ছবি বানাতে পারবেও না। এরা শুধুই পারিবারিক ছবি বানাতে পারে। সেটা করতে যে পেরেছি, তাতেই খুশি।

    শিবপ্রসাদ: একই উত্তর। দিদি যা বলেছেন আমারও সেই একই কথা।

    প্রশ্ন: ছবি হিট হতেই আপনারা ঠিক করলেন, সিকুয়েল আনবেন?

    নন্দিতা: হেসে শিবপ্রসাদের দিকে তাকালেন।

    শিবপ্রসাদ: দর্শক ছবি দেখে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘পার্ট ২’ চাই। নন্দিতাদি বললেন, ‘পার্ট ২’-এর পরিকল্পনা কর। ব্যস, ২০২৫-এর পুজোর ছবির পরিকল্পনা শুরু।

    প্রশ্ন: প্রবাদ বলে, লোহা গরম থাকতে থাকতে ঘা মারতে হয়। আপনারা দু’বছর সময় নিলেন! দর্শকদের উত্তেজনা মিইয়ে গেল?

    নন্দিতা: যে কোনও ছবি তৈরিতেই সময় লাগে। সত্যি ঘটনার উপর ছবি বানাতে প্রচুর গবেষণার দরকার। সেই সময় দিতেই হবে। আর আগ্রহ কমার কথা বলছেন? ‘রক্তবীজ ২’-এর মতোই দর্শক ‘বহুরূপী ২’ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে!

    শিবপ্রসাদ: আর কেউ এত তাড়াতাড়ি বানাতে পারত কি না জানি না। আমরা সত্যি বেশি সময় নিইনি। আর, যে কোনও জিনিসের জন্য অপেক্ষা থাকা ভাল। একটা জিনিস পাকতেও তো সময় লাগে! সেই সময় দিতেই হবে।

    প্রশ্ন: ছবির পটভূমিকায় ভারত-বাংলাদেশ। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয়। পরিচালনার সময় মনে হয়েছিল, এতে যদি আবার বিতর্ক তৈরি হয়?

    নন্দিতা: যেহেতু বিষয় আমাদের জানা, তাই ছবি তৈরির সময় কোনও দ্বিধা, কোনও ভয়, কোনও দুশ্চিন্তা কাজ করেনি। কারণ, ছবির গল্প ২০১৪-২০১৫ সালের। তখন তো দুই দেশের মধ্যে এই পরিস্থিতি তৈরিই হয়নি। সেই সময়ের গল্প বলছি। এখনকার গল্প তো নয়!

    শিবপ্রসাদ: একেবারেই তা-ই। আমরা কিন্তু দুই দেশের বন্ধুত্ব দেখিয়েছি।

    প্রশ্ন: আর ছবির তারকা নির্বাচন? সীমা বিশ্বাসই কেন শেখ হাসিনার আদলে?

    নন্দিতা: এটা শিবু বলুক।

    শিবুপ্রসাদ: প্রথম কথা, এই ‘স্টার’ কথাতেই আমার আপত্তি। এঁরা প্রত্যেকে অসম্ভব ভাল অভিনেতা। ওঁরাও সেটাই মনে করেন। আমরাও সেটাই মাথায় রেখে অভিনেতা নির্বাচন করেছি। ওঁরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। প্রত্যেকের অভিনয় দর্শকের ভাল লাগবে।

    প্রশ্ন: এ বার ‘প্রেসিডেন্ট’ ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় কী করবেন?

    নন্দিতা: (হেসে ফেলে) সব বলে দিলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে কী দেখবেন?

    শিবপ্রসাদ: গল্পে যখন দুই দেশ আসছে, তখন দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কের কথা থাকবে। রাজনীতিবিদদেরও নিজস্ব জীবন থাকে। তাঁদের পরিবার থাকে, সেখানে ঘাত-প্রতিঘাত থাকে, এ সবই দেখানো হবে। নিছক থ্রিলার বানাব, এমন উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু আমরা ‘রক্তবীজ’ বানাইনি। আমাদেরও যাতে ছবিটা বানাতে ভাল লাগে, সেই দিক দেখেছি। প্রত্যেক চরিত্রের যে একটা মানবিক আবেদন থাকে, তা দেখিয়েছি।

    প্রশ্ন: যেমন পুলিশও প্রেমে পড়ে, কাল্পনিক দৃশ্যে সমুদ্রতটে বিকিনি সাজে ধরা দেয়!

    নন্দিতা: (হা হা হাসি)। ভাল লেগেছে তো? আপাতত ওটুকুই থাক।

    শিবপ্রসাদ : (হেসে ফেলে ) ঠিক।

    প্রশ্ন: ছিপছিপে চেহারায় স্বল্পবসনা মিমি চক্রবর্তী পুরুষ পরিচালকের সামনে। শিবপ্রসাদ কি সামান্য সময়ের জন্য ‘আবেগে’ ভেসেছিলেন?

    শিবপ্রসাদ: (বড় করে শ্বাস নিয়ে) আমার তখন কী অনুভূতি হয়েছিল? আমার হাতে একটা আয়না ছিল। আমি তাতে সূর্যের আলো ফেলে প্রতিফলন তৈরির চেষ্টা করছিলাম। যেটা মিমির গায়ে ফেলতে হবে। ওই দৃশ্যের জন্য দরকার ছিল।

    প্রশ্ন : এতটাই নির্বিকার!

    নন্দিতা: বিদেশে আমরা খুব বেশি টেকনিশিয়ান নিয়ে যেতে পারিনি। নিজেদেরই সেই অভাব পূরণ করতে হয়েছে। ফলে, আমাদের ‘ফ্যান্টাসাইজ়’ করার সময় বা সুযোগ কোথায়?

    শিবপ্রসাদ: আমরা কেউ পাখা ধরেছি। মিমির চুল, পোশাক ওড়াতে হবে। আমার দায়িত্ব মিমির গায়ে প্রতিফলন ফেলা। কোনও স্থির চিত্রগ্রাহক নিয়ে যেতে পারিনি। ছবির কাহিনি-চিত্রনাট্যকার জ়িনিয়া সেন মাঝসমুদ্রে নেমে মোবাইলে ছবি তুলছেন। সে সব সামলাব না ‘ফ্যান্টাসাইজ়’ করব!

    প্রশ্ন : ‘রক্তবীজ’ মানে টানটান চিত্রনাট্য, সত্য ঘটনার চিত্ররূপ। সেখানে কেন পুলিশ বিকিনি পরে ‘কল্পদৃশ্য’-এ? দর্শক ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা?

    নন্দিনী: একেবারেই তা নয়। আমাদের চিত্রনাট্য এটাই চেয়েছে। তাই নায়িকাকে আমরা এ ভাবে উপস্থাপিত করেছি। ছবি দেখার পর দর্শকও সেটা বলবেন।

    শিবপ্রসাদ: আমাদের ছবিতে ‘আইটেম’ গানকে কখনও নিছক ‘আইটেম সং’ হয়ে উঠতে দেখেছেন? এই গান ছবির গল্প এগিয়ে নিয়ে যায়। না হলে ‘আমার বস’ ছবিতেও এই ধরনের গান থাকত। ‘অর্ডার ছাড়া বর্ডার ক্রস’ গানের কথাতেই গল্পের আভাস। শুধু গান হলে অন্য কথা বসানো হত।

    প্রশ্ন: সদ্য প্রকাশিত প্রচার-ঝলক বলছে, অভিনেতাদের ভিড়েও অঙ্কুশ হাজরা নজর কাড়বেন। এটা কী করে হল?

    নন্দিতা: আমি অঙ্কুশের আগের কোনও কাজ দেখিনি। ‘রক্তবীজ’-এ ‘কেন গোবিন্দ দাঁত মাজে না’ নেচে চলে গেল। আর শেষ দৃশ্যে একটু সময়ের জন্য উপস্থিতি। আমি নজর করিনি। তা ছাড়া আমি নায়িকাদের পছন্দ করি। নায়কদের পাশে বেশি ঘেঁষি না। অঙ্কুশ আমার নজর কেড়েছে। ১০ শতাংশ চাইলে ১০০ শতাংশ দিয়েছে। ও পরিচালকের অভিনেতা। আবীর সব সময়ের জন্য সিরিয়াস। অঙ্কুশ এসেই চমকে দিয়েছে।

    শিবপ্রসাদ: ‘মুনির আলম’ হতে গিয়ে কত কিছু করেছে জানেন! ওজন কমাল, অ্যাকশন করল, পাহাড়ে উঠেছে, সেখানে শট দিয়েছে— সব করেছে। ওর হাঁটুতে চোট। তা-ই নিয়ে এক শট একাধিক বার দিয়েছে। বুঝতে পারছি, ব্যথা করছে। তা-ও বলছে, ‘করে নেব’। আরও একটা বিষয় আছে...

    প্রশ্ন: কী?

    শিবপ্রসাদ: ‘টিম ইন্ডিয়া’ ইংলন্ডে দুর্দান্ত খেলল। কী করে? ওয়াশিংটন সুন্দর আর জাদেজার জন্য। কোচ গম্ভীর পর্যন্ত সুন্দরের প্রশংসা করেছেন। অঙ্কুশ সে রকমই। টলিউড একজন ভাল খেলোয়াড়কে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছে। সাত কিংবা আট নম্বরে খেলিয়েছে। দিনের পর দিন পাত্তা দেয়নি। কোনও কোচ তাঁকে দিয়ে চার নম্বরে খেলালেন। অভিনেতা ১০০ রান করলেন। বাকিদের তখন টনক নড়ল, বাহঃ, এ তো বেশ খেলে! অঙ্কুশের মতো এ রকম আরও অনেক অভিনেতা আছেন, যাঁরা সুযোগই পান না। পেলে তাঁরাও দেখিয়ে দিতে পারেন। যেমন, অনুরণন, রাজু ধর।

    প্রশ্ন: এই গান, এই ছবি, অঙ্কুশ হাজরা-নুসরত জাহান বা মিমি চক্রবর্তী-নুসরত জাহানকে মিলিয়ে দিল...

    শিবপ্রসাদ: দেখুন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যখন চোদ্দো বছর পরে একসঙ্গে কাজ করেছেন, তখন পৃথিবীতে সব হয়। ওঁদের এক ছবিতে ধরা সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। সেটা যখন পেরেছি তখন, ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের কাছে ‘অসম্ভব’ বলে আর কিচ্ছু নেই। ৩০ বছর পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে আমরা ক্যামেরায় ধরেছি। সেটাও ভাবুন।

    প্রশ্ন: টিজারের পর ট্রেলার। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় মিমির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইন্ডাস্ট্রি বলছে, উইন্ডোজ প্রযোজনা সংস্থা সাবালক হওয়ার চেষ্টায়...

    নন্দিতা: (ফের হা-হা হাসি) কিচ্ছু বলার নেই।

    শিবপ্রসাদ: যে যা বলছেন, খুব ভাল বলছেন। আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি।

    প্রশ্ন: তা হলে বিতর্ক অনুযায়ী, এ বার পুজোয় দেব বনাম আবীর?

    শিবপ্রসাদ: (মুচকি হেসে) আবীর বনাম দেব-ও হতে পারে।

    নন্দিতা: আমরা দর্শকের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।

    প্রশ্ন: রইলেন বাকি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘দেবী চৌধুরাণী’...

    শিবপ্রসাদ: দাদা তো প্রণম্য। ৩০ সেপ্টেম্বর ওঁর জন্মদিন। শারদীয়ায় তাই ওঁর ছবি থাকবেই। দাদাও পুজোয় আসবেন।

    প্রশ্ন: চারটি ছবির তিন নায়ক, প্রসেনজিৎ-দেব-আবীর। চওড়া হাসি হাসবেন কে?

    নন্দিতা: দর্শক বলবেন! আমরা কেন বলব?

    শিবপ্রসাদ: দিদি সব সময় একটা কথা বলেন, জোরালো বিষয় যাঁর, জিত তাঁর। এটা ভিতর থেকে মানি। পুজোয় প্রত্যেকে ভাল ছবি আনছেন। দর্শকের যে ছবি ভাল লাগবে সেই ছবি ভাল ফল করবে।

    প্রশ্ন: নতুন, পুরোনো অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নন্দিতা-শিবপ্রসাদ দেব-জিৎ-অঙ্কুশের পরের প্রজন্ম খুঁজে পেলেন?

    শিবপ্রসাদ: আগামীদিন অভিনেতাদের। বিষয়ভিত্তিক ছবির দিন। ছবির বিষয়ের সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে যে অভিনেতা নিজেকে মানিয়ে নেবেন তিনি-ই থেকে যাবেন।

    প্রশ্ন: আপনার নায়িকা ‘ঝিমলি’কে শেষে অঙ্কুশের হাতে তুলে দিলেন!

    নন্দিতা : জোরে হাসি।

    শিবপ্রসাদ: (হাসতে হাসতে) ‘আয়েশা’। ‘রক্তবীজ ২’-এ কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখবেন। তার পর ফোন করে বলতে বাধ্য হবেন, ‘কী দেখলাম’!

    প্রশ্ন: ‘বহুরূপী’ কি আগামী পুজোয়?

    শিবপ্রসাদ: হতেও পারে! এ বছর তো আর সুযোগ নেই (হাসি)। আমরা পরিবেশক এবং ইম্‌পা-কে জানিয়ে দিয়েছি, আগামী পুজো এবং বড়দিনে আমরা আসব। কখন, কোন ছবি? সেটা না হয় ক্রমে জানবেন।

    প্রশ্ন: অর্থাৎ, উৎসব শুধুই বড় পরিচালক, প্রযোজকের?

    শিবপ্রসাদ: তেরো বছর লেগেছে এই জায়গায় পৌঁছোতে। আমার আর নন্দিতাদির। তেরো বছর বাদে পুজোয় আমরা যে ছবি করেছি তাতে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, পরিবেশক এবং প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরও। আশা, এ বছরেও দর্শক আমাদের ফেরাবেন না।

    প্রশ্ন: ‘আইটেম’ গানে নেচে অঙ্কুশ খলনায়ক। ‘রক্তবীজ ৩’-এ তা হলে নুসরত খলনায়িকা?

    নন্দিতা: হতেই পারে।

    শিবপ্রসাদ: তার জন্য ধৈর্য ধরে সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।

    রেকর্ডার বন্ধ হতেই চওড়া হাসি পরিচালক জুটির মুখে। শিবপ্রসাদ বলে উঠলেন, “দেখুন তো! শুধু ছবি নিয়ে কী ভাল আড্ডা হল...।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)