সকাল থেকে রাত, দু’চাকার বাহনেই যেন সংসার! খারাপ-ভালো, ‘গিগ অর্থনীতি’, যাত্রীর অভিযোগের পাহাড়েও বাইক চালিয়েই চলে সবটা। ভালো-মন্দের উপাখ্যানে আয় কম নেই, তবে দোসর অনেকটা অস্বস্তি। কীভাবে দুর্গাপুজো কাটে অনলাইন বাইক চালকদের? কলম ধরলেন অ্যাপ বাইক চালক মৃগাঙ্ক নাগ।
সামনেই দুর্গাপুজো। মা আসছেন। ইতিমধ্যেই আলোয় সেজেছে কলকাতা। প্রত্যেক মুহূর্তে ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে এখন থেকে পথে নামছেন সাধারণ মানুষ। পুজোর ভিড়ে জমজমাট রাস্তাঘাট। পুজো এলে অন্যদের মতো আমারও খুব ভালো লাগে। উৎসবের আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি আমিও। কিন্তু উৎসবের মাঝে মনখারাপও হয়। কী করতাম, আর কী করছি, এই ভেবে। হয়তো অন্য কাজ করতাম। এই পেশায়, মানে এই দিনমজুরের মতো কাজে আয় খুব খারাপ, তা নয়। কিন্তু সমস্যাও আছে প্রচুর। পুজো এলে সবকিছুই বেড়ে যায়। মন কেমনের গল্পে মনে হয়, সত্যি ভালো আছি তো?
আসলে পুজো মানেই সবার জন্য আনন্দের সময়। কিন্তু আমার মতো অ্যাপ বাইক চালকের কাছে বছরের এই দিনগুলো সবচেয়ে দুশ্চিন্তার। তার কারণ, রাস্তা। ভিড়ে ঠাসা রাস্তা চিন্তা বাড়িয়ে দেয় রোজ। আয় হবে তো? এই প্রশ্ন কড়া নাড়ে বারবার। পুজোর সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, ঘুরপথে যেতে হয় অধিকাংশ গন্তব্যে। পৌঁছতে সময় বেশি লাগে, আর আয় কমে পাল্লা দিয়ে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যাত্রী কম, রাত কিংবা ভোরে একটু বেশি কাজ হয়। বাকি সময় রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
সবাই ভাবেন পুজোয় আমাদের ভালো আয় হয়। কিন্তু সত্যিটা হল, এই সময়টাই আমাদের সবচেয়ে অনিশ্চিত দিন কাটে। পুজোর সময় আয় বলতে যাত্রীদের মধ্যে কেউ খুশি হয়ে যদি বাড়তি ভাড়া দেন, আবার অনেকেই ন্যূনতম ভাড়াটুকুই দিয়ে চলে যান। তবুও খরচ তো থেমে থাকে না। সংসারের খরচ চালানো, দাদুর ওষুধ জোগাড় করা, মায়ের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা, সবই মাথায় ‘চাপ’ হয়ে থাকে। অথচ নিজের জন্য কবে নতুন জামা পরে অষ্টমীতে অঞ্জলি দিয়েছি, মনে পড়ে না আর!অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। মা একাই আমাকে বড় করেছেন অনেক কষ্টে। ছোটবেলায় আবদার করতাম, বুঝতাম না। এখন বড় হয়ে বুঝেছি সেই দুঃখের মানে। তাই আজ নিজের জন্য কিছু চাই না। শুধু চাই মা, দাদুকে নিয়ে সুস্থভাবে থাকতে।
পুজো আসে, পুজো যায়। প্যান্ডেলের থিম পালটায়, আলো পালটায়। কিন্তু আমাদের জীবনে তেমন কোনও বদল আসে না। বাইকই ভরসা, বাইকই জীবন। গত তিন-চার বছর ধরে বিভিন্ন অনলাইন নির্ভর অ্যাপ বাইক চালাই। এর আগে ডেলিভারি করতাম, কিন্তু আয় কমতে থাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়। এখন প্রতিদিন ৮-৯ ঘণ্টা রাস্তায় থাকি। লক্ষ্য থাকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা রোজগার। না হলে ঘরে ফেরা নেই।
বাঁশদ্রোনির রানিয়া উদয়ন পল্লীতে থাকি মা আর দাদুকে নিয়ে। মা-ও কাজ করেন। একার পক্ষে আজকের দিনে সংসার চালানো সম্ভব নয়। প্রতিদিন বাইক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভগবানের নাম নিই। কারণ বৃষ্টি নামলে কষ্ট আরও বেড়ে যায়। ভিজে জামা গায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইক চালাতে হয়। লোকেশন দেখে যাত্রী নামাতে গিয়ে দেরি হলে অনেকে বিরক্তও হন। কারণ আমাদের তো আবার ফোন নিয়েই কাজ। তবুও ভরসা তো রাখতে হয়। কারণ এই বাইকের চাকাই আমাদের জীবন, এই চাকার জন্যই তো আমার সংসার চলে।