• ফ্রাঙ্কফুর্টের পুজো শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে দেয় প্রবাসীদের
    আনন্দবাজার | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • যদিও যুদ্ধ-সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ব,তবু‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর’ মনে মনে এই লাইন গুঞ্জন করছেন না দেশে-বিদেশে এমন বাঙালি অপ্রতুল। দফায় দফায় পুজো মিটিং, পাড়ায়, আবাসনে, বারোয়ারি হোক বা বাড়ির পুজো, প্যান্ডেল বাঁধা ও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে,সর্বত্র। কিন্তু নিজভূমি ছেড়ে যাঁরা অনেক দূরের দেশে আছেন তাঁরাও শারদীয়ায় দুর্গাদেবীর আরাধনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকেন না। যদিও সারা জার্মানি এই মুহূর্তে ইউক্রেন ও সিরিয়ার শরণার্থীদের নিয়ে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত তবু জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের কাছেই রসবাখে গত পাঁচ বছর ধরে মা আসছেন সদলবলে।

    ইউরোপের এই শহরে বহু বঙ্গসন্তানের বসবাস। প্রায় অর্ধশতক এই শহরেই জীবন অতিবাহিত করেছেন, এমন বাঙালির সংখ্যাও অনেক। সারা ফ্রাঙ্কফুর্ট জুড়ে আদি-নব্য মিলিয়ে অনেকগুলি বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজন হচ্ছে বহু বছর ধরে। এই শহরেই যেমন প্রায় ৪৫ বছর অতিক্রান্ত ‘আদি সার্বজনীন দুর্গোৎসব’ এবং প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো ‘রাইন মাইন বেঙ্গলি কালচারাল এ্যাসোসিয়েশন’-এর দুর্গাপূজা বেশ বিখ্যাত বারোয়ারি পূজা। তেমনই ফ্রাঙ্কফুর্টের তরুণ প্রজন্মের বাঙালিরা মেতে ওঠেছে রসবাখের 'চক্রবর্তী বাড়ির পুজো' আয়োজনে, যেটি একান্তভাবেই বাড়ির পুজো হিসেবে শুরু হয়ে পাঁচ বছরেই বাঙালির সেই হারিয়ে যাওয়া সংযুক্ত বর্ধিত পারিবারিক পুজোর রূপ পেয়েছে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ষোলোয়ানা বাঙালিআনা এবং পুরো দস্তুর বাঙালি সংস্কৃতির পরম্পরা ও ঐতিহ্য মেনেই পরবাসে এই পূজা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে করা হচ্ছে। ২০২০ সালে কোভিড আবহে ফ্রাঙ্কফুর্টে বারোয়ারি পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, প্রথম অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে চক্রবর্তী দম্পতি এই পুজো শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এঁদের অতি নিকট বন্ধু-প্রতিবেশীরা, যাঁরা একদিন নিজেদের শিকড় ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে ইউরোপে এসেছিলেন, তাঁরা এখন একটি ‘বর্ধিত পরিবার’ হয়ে এই পুজোর ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সমস্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

    পঞ্চম বছরে পদার্পণ করা একান্ত পারিবারিক এই পুজোর বিশেষত্ব হল, এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি মানুষ নিজেরাই আপন উদ্যোগে নিজেদের পুজোর কাজে নিযুক্ত করেন। সেই জন্যই এটি সকলের পুজো।এই ঘরোয়া মাতৃবন্দনায আন্তরিকতা, ভালেবাসা, সহযোগিতা ও নিষ্ঠায় ভরপুর। পক্ষপাতমুক্ত এই আরাধনায় ‘পুজো কমিটি’ বলে কিছু নেই, কোনও আর্থিক চাঁদার ব্যাপার নেই। শুধু ভালবেসে পুজোর কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উদার আহ্বান আছে। যে কোন ধর্মাবলম্বী মানুষ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে হিন্দু, জৈন, শিখ, খ্রিষ্টান, ইহুদি, মাড়োয়ারি,গুজরাতি, পাঞ্জাবি, বিহারি, এমনকি জার্মান, আমেরিকান, আফ্রিকানরাও এই পুজোর আনন্দ আয়োজনে শামিল হন। এই মাত্র কয়েক বছরেই চক্রবর্তী বাড়ির পুজোর জনপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে একটি উদাহরণ যথেষ্ট— প্রতিবেশী দেশ নেদারল্যান্ডস,স্পেন, অস্ট্রিয়া,বেলজিয়াম ছাড়াও জার্মানির অন্যান্য শহর থেকে বিপুল পরিমাণ আত্মীয়-বন্ধুর সমাগম হয়।

    পুজোর চারটি দিন তিথি নির্ঘণ্ট মেনেই পুজো হয়। বোধন, সন্ধিপুজো, অঞ্জলি, নিত্য চণ্ডীপাঠ, কলাবউ স্নান , নবমীতে কুমারী পুজো, সিঁদুর খেলা ও মায়ের দর্পণ-বিসর্জন সবই পালন হয়। পুজোর তিন মাস আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। চারটি দিন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা হয়। এই বছরের বিশেষ আকর্ষণ শ্রুতিনাটক ও শাস্ত্রীয় নৃত্য। পঞ্চমীতে আগমনী গান দিয়ে পুজো শুরু হবে। মহিলারা মিলে লোকনৃত্য পরিবেশন করবেন। প্রবাসের এই পুজোকে উপলক্ষ করে নিজেদের দেশ, শিকড় ও সংস্কৃতিকে থাকার চেষ্টা করেন এখানকার বাঙালিরা। সেই সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের বিদেশের মাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাদের আপন মাতৃভূমির সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতও করার গুরু দায়িত্ব পালন করা হয়। পেটপুজো ছাড়া বাঙালির কোনও অনুষ্ঠানই পূর্ণ হয় না। খিচুড়ি থেকে লাবড়া, লুচি ও ভাজাভুজি, ইঁচোড়ের কালিয়া, ছানার ডালনা, পটলের দোলমার মত নয় নিখাদ বাঙালি রান্নাগুলি তো থাকেই, সেই সঙ্গে, দশমীতে বাসন্তী পোলাও ও পাঁঠার মাংস দিয়ে পুজোর ভোজের সমাপ্তি হয়। প্রত্যহ শেষ পাতে চাটনি ও পায়েস থাকবেই। সব রান্নাই করেন পরিবারের মেয়ে-বউরা। এই পুজো প্রবাসের বাঙালিদের তাদের শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দিয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি পরিচয়ের মহিমা। কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো কিংবা বাগবাজার বা ম্যাডক্সের আড্ডা সবই কখন ফ্রাঙ্কফুর্ট রসবাখের পুজোর অংশ হয়ে যায়।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)