• শিউলি-কাশফুল-তর্পণে বাঙালি মননে আগমনির জলতরঙ্গে সুর তোলে মহালয়া
    বর্তমান | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সৌম্য দে সরকার, মালদহ: বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের মতো দুর্গাপুজোরও একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। হৃদয়ে এক মন জুড়িয়ে দেওয়া জলতরঙ্গ বেজে ওঠে এই গন্ধের অনুভবে। মহালয়া থেকেই শুরু হয় এই জলতরঙ্গের মূর্ছনার অনুরণন। মা আসছেন। মায়ের এই যাত্রা শুরুর মুহূর্ত আম বাঙালির জন্য মহালয়াকে ঘিরে এক ভিন্নমাত্রার চিরন্তন সুখানুভূতি তৈরি হয়। মহালয়া তাই বাঙালির জীবনে এক গভীর ব্যঞ্জনার দ্যোতক হয়ে ওঠে স্থান, কাল ভেদে। 

    মহালয়া শুধু মায়ের নিজের ঘরে ফিরতে যাত্রা শুরুর পবিত্র মুহূর্তই নয়। মহালয়া মানে বাংলা জুড়ে আরও অনেক কিছু। রথযাত্রার পুণ্যতিথিতেই মা দুর্গার মূর্তি নির্মাণের কাঠামো পুজো শুরু হয়ে যায় অনেক জায়গাতেই। মহালয়ায় দেবী চণ্ডীর স্তবের মাধ্যমে ঘোষিত হয় পৃথিবীতে মা দুর্গার আগমনী। পৃথিবীতে মায়ের পদার্পণের পথে বাংলার রাস্তায় রাস্তায় শিউলি ফুলের ইতস্তত আলপনা সাজিয়ে রাখে প্রকৃতি। কমলা-সাদা রঙের এই ছোট্ট শিউলি ফুলের সম্ভার মহালয়ার মুহূর্তকে আরও বাঙ্ময় করে তোলে। প্রকৃতি ‘শিউলি ছোপানো শাড়িখানি পরে’ আগমনীর সুর ধ্বনিত করে সারা রাজ্যের সঙ্গে মালদহেও। তাই শিউলি এবং মহালয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। 

    শুধু শিউলি নাকি! মালদহ শহর কংক্রিটে বোঝাই হলেও জেলার গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও সবুজ মাঠ, খেত, জলাশয়ের আশেপাশে চোখে পড়ার মতো উচ্চতায় মাথা দোলায় কাশফুলের সম্ভার। এই কাশ যেন বহন করে আনে দুর্গাপুজোর সময় বাঙালিদের অবকাশের বার্তা। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা আরও স্পষ্ট হয় শরতের মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলের মাথা দোলানোতে। 

    সপরিবারে মা’কে কাছে পাওয়ার উদ্দীপনায় বাঙালি ভুলতে চায় সব শোক, তাপ, জরা, রোগ, দুঃখ। মহালয়ার সূর্য তাই শুধুই আনন্দময়। পুণ্যতোয়া গঙ্গা মালদহ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যায়। তবে, মহালয়ায় পিতৃপক্ষের অবসানে পূর্বপুরুষকে তিলজল দানের অদম্য ইচ্ছায় মহানন্দা সহ মালদহের সব নদীই যেন গঙ্গা হয়ে ওঠে মহালয়ায়। দুর্গাপুজোয় জগজ্জননী মা দুর্গা সপরিবারে মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত যৌথ পরিবারের মাহাত্ম্য স্মরণ করিয়ে দেন আপামর বাঙালিকে। মহালয়া তেমনই এক উৎসের সন্ধানে যাত্রা। পিতৃপুরুষ, মাতৃপুরুষ সহ যাঁরাই স্থূল শরীর ছেড়ে অবস্থান করেন অন্য কোনও লোকে তাঁদের উদ্দেশ্যে তিলজল প্রদান করার মুহূর্তও এই মহালয়াই। স্মার্টফোন, গ্যাজেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স  কোনও কিছুই যেন বাঙালির মনন থেকে সরিয়ে দিতে পারে না তাঁদের শিকড় আঁকড়ে থাকার অদম্য জেদকে। এখানেই যেন পিকনিক, ডিজে আর হইহুল্লোড়ের বাইরে শিউলি, কাশফুলের মন ভালো করে দেওয়া অনুভূতি আর তর্পণের আন্তরিকতায় অটুট থাকে মহালয়ার মাহাত্ম্য। 
  • Link to this news (বর্তমান)