• শাস্ত্রে মহালয়ার অর্থ এবং ব্যাপ্তি বহুমাত্রিক
    বর্তমান | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • স্বামী তাপহরানন্দ:

    মহালয়ার শঙ্খধ্বনিতে আমাদের মনে আনন্দের শিহরণ ওঠে। দিনটি আমাদের ভারতীয়দের জীবনে তথা হিন্দু সংস্কৃতিতে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এদিন পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা। এ সম্পর্কে স্মৃতিকার রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্ব’, গোবিন্দনন্দনের ‘বর্ষাক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রুদ্রধরের ‘বর্ষকৃত্য’ গ্রন্থে অনুষ্ঠানের বিধান আছে। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের ‘স্মৃতিচিন্তামণি’ গ্রন্থে বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রমাণ দিয়ে বলা হয়েছে, অপর পক্ষের প্রতিপদ থেকে পনেরোটি  তিথির পার্বণ বিধিতে শ্রাদ্ধ করা উচিত।  অপরপক্ষ মানে এখানে কৃষ্ণপক্ষ অর্থাৎ মহালয়া। অমাবস্যার পূর্বের পক্ষটিকে বোঝায় যা পিতৃকার্যের জন্য প্রশস্ত। অমাবস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণ শাস্ত্র বলছে- ‘পূর্বপক্ষো দেবানামপরপক্ষঃ পিতৃণামিতি’।

    এজন্য ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে সম্পূর্ণ একপক্ষকাল ধরে প্রতিদিন তিল-তর্পণ অর্পণ করে পূর্বপুরুষদের জন্য শান্তি কামনা করা হয়। যাঁরা এক পক্ষকাল ধরে পূর্বপুরুষদের তর্পণাদি করতে পারেন না, তাঁরা এই মহালয়ার দিনটি তিল তর্পণ,  পার্বণ শ্রাদ্ধ, দানাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেন।  তর্পণ কথার অর্থ হলো তৃপ্তি বিধানের নিমিত্ত অঞ্জলি পূর্ণ জল নিবেদন। পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে গঙ্গার ঘাটে এই উদ্দেশ্যেই  তর্পণ করা হয়। ওঁ কুরুক্ষেত্রং গয়া-গঙ্গা-প্রভাস পুষ্করাণিচ। তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি তর্পণ-কালে ভবন্ত্বিহ।।

    আমরা জানি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন শরশয্যা গ্রহণ করলেন, তখন দক্ষিণায়ণ চলছে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু বর ছিল।  তিনি তখন ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে উত্তরায়ণ না আসা পর্যন্ত প্রাণ ত্যাগ করবেন না ।

    ‘রবির উত্তরায়ণ হইবে যখন, জানিহ তখন আমি ত্যজিব জীবন।

    আশ্বিন মাস হল উত্তরায়ণের শেষ মাস। তাই এমাসে পরলোকগত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উত্তরায়ণের শেষ তর্পণ করে পার্বণশ্রাদ্ধ করার বিধান আছে। 

    মহালয়া হল স্ত্রীলিঙ্গান্ত পদ। মূল শব্দ হলো মহালয়। স্ত্রীলিঙ্গ ‘তিথি’ শব্দের বিশেষণ বলে মহালয় শব্দটি মহালয়া হয়েছে। এই কারণে আমরা বলি মহালয়া তিথি। মহালয় কথার অর্থ মহা আলয় অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ আলয় অথবা বলতে পারি শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। আমরা এও বলতে পারি মহতের আলয়। মহতের পরমস্থান। মহৎ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে যাঁরা শ্রেষ্ঠ, তাঁদের কথা। অর্থাৎ যোগীদের কথাও বলতে পারি। এছাড়া ‘মহা’ এবং ‘লয়’ অর্থাৎ পরমলীন। এই পরমলীন অবস্থা হল মহতাদির লয়, যা পরমাত্মায় বা পরব্রহ্মে লীন বা মোক্ষ অবস্থা। সাংখ্যদর্শন মতে মহতাদি বলতে বোঝায় মহৎ, অহংকার ও পঞ্চতন্মাত্র। পঞ্চতন্মাত্র হলো  শব্দ, স্পর্শ, রূপ,  রস ও গন্ধ । এই সব কিছুই লয় হয় যে পরমাত্মায়, সেই পরমাত্মা বা পরব্রহ্মই মহালয়।  আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আমরা ব্ল্যাক হোল বলি। এখানেই লয় এবং এখান থেকেই উৎপত্তি। এই পরম ও চরম লয় প্রাপ্তি যে তিথিতে, তাকেই বলে মহালয়া অমাবস্যা তিথি।

    মহালয়ার আরেকটি অর্থের কথা বলা যেতে পারে। ‘মহ্যন্তে  পূজ্যন্তে দেবাদয়োহস্নিন্নিতি। এটি দেবতাদের পূজার প্রশস্ত সময়। এই মহালয়া তিথিতেই মহাপূজার শুভ আরম্ভ। বাজসনেয়িসংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে আছে- ‘শরৎকাল দেবতাদের অর্চনার প্রশস্ত সময়- শারদেন ঋতুনা দেবাঃ’। দুর্গার আর এক নাম শারদা। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে অম্বিকা বলতে শারদাকে অভিহিত করা হয়েছে। 

    ‘শারদা তস্যাম্বিকা স্বসা’। আবার শারদা শব্দের অর্থ শরৎকাল বিষয়িনী। যা মূলত দেবী দুর্গাকে বোঝায়। শরৎকালকে দেবী দুর্গার আরাধনার প্রশস্ত সময় বলা যেতে পারে। সব মিলিয়ে মহালয়া মানে মহামায়ার আগমন বার্তা। মহালয়া মানে দুর্গাপূজার আনন্দঘন অনুরণন। মহালয়া মানে দুর্গোৎসব তথা শারদ উৎসবের শুভসূচনা।

    (লেখক প্রধান শিক্ষক, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির, মালদহ)
  • Link to this news (বর্তমান)