• বদলে যায় বাহন, দশমীতে দেবী আরাধনা শুরু ডুয়ার্সে
    বর্তমান | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ব্রতীন দাস  জলপাইগুড়ি

    বিসর্জনেই বোধনের সুর! দশমীর বিষাদ থেকেই শুরু উৎসব। ফের দুর্গাপুজোয় মাতে ডুয়ার্স। তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক নদীপাড়ের বাসিন্দারা ব্রতী হন এক ‘অন্য’ উমা আরাধনায়। এখানে বদলে যায় দেবীর বাহন। সিংহের বদলে থাকে বাঘ। এই উমা একেবারে গাঁয়ের বধূ। মুখে মঙ্গোলীয় জনজাতির ছাপ স্পষ্ট। ঠিক যেন রাজবংশী সমাজের প্রতিনিধি। রক্তিম বর্ণ। কেউ বলেন, দেবী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা।  

    প্রচলিত বিশ্বাস, দশমীতে গাঁয়ের বধূর বেশে উত্তরের বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কৈলাসে ফিরছিলেন উমা। রাতের অন্ধকারে অরণ্যের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলেন তিনি। পথভ্রষ্ট ওই বধূকে দেখতে পেয়ে নিজেদের গ্রামে নিয়ে যান রাজবংশী সমাজের কিছু লোক। চাষির ঘরে রাত কাটিয়ে পরদিন ফের কৈলাসের পথ ধরেন উমা। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁর আপ্যায়নে ত্রুটি রাখেননি চাষিবাড়ির মেয়ে-বউরা। সেই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার আগে নিজের আসল পরিচয় দেন দেবী। এবং চাষির ঘরের গোলা যাতে পূর্ণ থাকে, তার বর দিয়ে যান। সেই থেকেই দশমীতে দুর্গার আবাহন শুরু উত্তরের কিরাত ভূমির প্রান্তরে। তবে কিছুটা অন্যরূপে। এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী নন, তিনি শস্যের দেবী। মা ভাণ্ডানী। দেবী ঠাকুরানি নামেও পরিচিত তিনি। কোথাও আবার তিনি বনদুর্গা। দশহাতের বদলে দেবী এখানে দ্বিভুজা। তবে সময়ের সঙ্গে ভাণ্ডানীর মূর্তিতে বদল আসছে। এখন সর্বত্র দেবী ভাণ্ডানী দ্বিভুজা নন, কোথাও কোথাও চতুর্ভুজা। তাছাড়া সব জায়গায় দেবীর গায়ের রং রক্তবর্ণা হয় না। পুজো উপলক্ষ্যে কোথাও পাঁঠাবলি হয়। কোথাও ওড়ানো হয় পায়রা। মূলত এই পুজো করে থাকেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। ভাণ্ডানী পুজো আগে একদিনের হলেও, এখন দুর্গাপুজোর মতোর চারদিনের। মেটেলির দক্ষিণ ধূপঝোরায় ভাণ্ডানীর বাহন সিংহ। সেখানে একইসঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও মহাকালের পুজো করা হয়। জঙ্গল থেকে হাতি বেরিয়ে এসে যাতে কোনও ক্ষতি না করে, সেই প্রার্থনাতেই মহাকালের পুজো করা হয়ে থাকে। কুমারগ্রামের নারারথলি গ্রামেও আরাধনা হয় ভাণ্ডানীর।  

    রাজবংশী সমাজে পিতৃপক্ষ কিংবা মাতৃপক্ষ বলে কিছু নেই। যেটা আছে তা হল, অনেকটা অর্থনৈতিক বিন্যাসের উপর নির্ভর করে দু’টি আলাদা উৎসব। অতীতে রাজবংশী জোতদাররা নবমীতে দেবীর আরাধনা করতেন। যা ‘মাত্রা’ পুজো নামে পরিচিত। জোতদারি না থাকলেও আজও ময়নাগুড়ির আমগুড়ির বসুনিয়া পরিবারে দশভুজার আরাধনার পাশাপাশি ‘মাত্রা’ পুজো হয়ে থাকে। আর রাজবংশী কৃষকরা দশমীতে করতেন ‘যাত্রা’ পুজো। মূলত চাষাবাদ যাতে ভালো হয়, সেই প্রার্থনা করেই হতো এই পুজোর আয়োজন। আজও গ্রামে আড়াই পাক লাঙল না ঘুরলে অর্থাৎ যাত্রাপুজো সম্পন্ন না হলে বসুনিয়া পরিবারের মা দুর্গার নিরঞ্জন হয় না। যাত্রাপুজো শেষে শুরু হয় ভাণ্ডানীর আবাহন।  

    বসুনিয়া পরিবারের সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুনীল বসুনিয়া বলেন, দশমীতে গ্রামের কৃষকরা প্রত্যেকেই লাঙল নিয়ে জমিতে গিয়ে কৃষিযন্ত্রাংশ পুজোর পর আড়াই পাক কর্ষণ করেন। ওই কর্ষণের জমিতেই বোনা হয় শীতের শস্য। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রীতি।

    তিস্তা-তোর্সা, রায়ডাক, কালজানি পাড়ের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, পুজোয় দেবী ভাণ্ডানী তুষ্ঠ হলে শস্যে ভরিয়ে দেন গোলা। গবেষকদের মতে, ভাণ্ডার থেকেই সম্ভবত ভাণ্ডানী নামকরণ। অন্নপূর্ণা যেমন দেবী পার্বতীর একটি রূপ, একইভাবে শস্যভাণ্ডার ভরিয়ে তোলার জন্য ভাণ্ডানী রাজবংশী সমাজের কাছে দেবী অন্নপূর্ণা।  

    আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক উমেশ শর্মা বলেন, ক্রান্তি, বাঁকালি, হেলাপাকড়ি সহ ডুয়ার্সের বহু জায়গায় ভাণ্ডানীর পুজো হয়ে থাকে। আগে রাজবংশী সমাজের পুরোহিতরাই ভাণ্ডানী পুজো করতেন। তাদের বলা হতো দেউসি। এখন অবশ্য বাঙালি পুরোহিতরাই পুজো করে থাকেন। 

     ফাইল চিত্র।
  • Link to this news (বর্তমান)