• মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ির পুজো: এখনও‘তামি’তে নির্ধারণ হয় সন্ধিক্ষণ
    বর্তমান | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সুমন তেওয়ারি  আসানসোল

    মুঠোফোনের জমানায় আজ গোটা বিশ্ব কার্যত হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বাড়ির হেঁশেলের খবর হোক বা বাবা-ছেলের কথোপকথন, সবেতেই ভরসা মোবাইল। এহেন ডিজিটাল যুগে যেন প্রযুক্তিকে একরকম ব্রাত্য করে রাখার যুদ্ধ লড়ছেন মিঠানি ও সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা। কুলটি থানা এলাকার এই জায়গাটি যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মোবাইল, ল্যাপটপের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রাংশের ছড়াছড়ি। কিন্তু পুজোর ক’টা দিন তাঁরা যেন হঠাৎ করেই অনেকটা সময় পিছিয়ে যান। যখন মানুষের বার্তা বহণ করে নিয়ে যেতে ভরসা ছিল ‘রানার’। সময় জানার জন্য ছিল না আধুনিক ঘড়ি, মোবাইল। আজও সেই রীতি মেনে মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ির পুজোয় সন্ধিক্ষণ নির্ণয় করার জন্য ব্যবহার করা হয় তামার এক বিশেষ পাত্র। এটিকে স্থানীয়রা ‘তামি’ বলেন। চক্রবর্তী বাড়িতে তামির মাধ্যমে সন্ধিক্ষণ নির্ধারণ হওয়ার পর লোকমুখে সেই বার্তা অন্য গ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। এখনও সেই রীতির দেখা মেলে অষ্টমীর সন্ধিতিথিতে।

    আনুমানিক ২৫০বছর আগে মিঠানির চক্রবর্তী বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। বনেদি বাড়ির পুজোয় আড়ম্বরের কোনও ঘাটতি ছিল না। সেখানে ‘তামি’র মাধ্যমে সন্ধিক্ষণ নির্ণয়ের এক বিশেষ বিধান রয়েছে। প্রথমে একটি বড় পাত্রে জল ভরা হয়। এরপর সেই জলে ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট একটি তামার পাত্র ভাসানো হয়। ওই ছিদ্র দিয়ে তামার পাত্রে ধীরে ধীরে জল ঢোকে। নির্দিষ্ট সময়ে তামার পাত্রটি জলে ডুবে যায়। তামার পাত্রটি কতবার ডুবলে সন্ধিপুজোর বলিদানের সময় নির্ধারণ করা যাবে তা গণতকাররা বলে দেন। তাছাড়া পঞ্জিকাতেও সেবিষয়ে উল্লেখ থাকে। তামির মাধ্যমে সময় নির্ধারণের পদ্ধতিটি এখানে ২৫০বছর আগে চালু হয়। কিন্তু অন্যান্য গ্রামে এই ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সন্ধিপুজোর নির্ঘণ্ট জানতে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ চক্রবর্তীদের থানে অপেক্ষা করত। চক্রবর্তীরা চিৎকার করে সন্ধির সময় ঘোষণা করতেন। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। রিলে সিস্টেমে সেই সন্ধির বার্তা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের মানুষের চিৎকারে পৌঁছে যেত। বহু গ্রামে রাস্তাও ছিল না। সন্ধির বার্তা নিজের গ্রামে নিয়ে আসার জন্য মানুষ মাঠে-ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকত। এইভাবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বার্তা পৌঁছে যেত। তবে এখন যুগ বদলেছে। সবার হাতেই রয়েছে মোবাইল, ঘড়ি। চাইলেই পঞ্জিকা মতে সন্ধির বলিদান করা যায়। কিন্তু এখানকার মানুষ আজও নিজেদের সেই পুরনো রীতি ধরে রেখেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধিপুজোর সময় কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে ডিজিটাল-প্রভাবমুক্ত জীবনের আনন্দ উপভোগ করেন। তাই এবছরও তামির মাধ্যমেই সন্ধিপুজোর নিঘণ্ট নির্ণয় হবে। তার জন্য চক্রবর্তী দালানে হাজির থাকবেন তামি বিশেষজ্ঞ।

    মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ির বাসিন্দা গোপাল চক্রবর্তী, চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীরা বলেন, পূর্বপুরুষদের রীতি মেনে আমরা এখনও দুর্গাপুজো করে আসছি। আমাদের মন্দির থেকেই সন্ধির বার্তা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা সৌমিত্র রায়, পূর্ণেন্দু রায়রা বলেন, মিঠানির চক্রবর্তী মন্দির থেকেই সন্ধির বার্তা আমরা লোকমুখে আমাদের বড় ধেমো গ্রামে পৌঁছে দিই।
  • Link to this news (বর্তমান)