বাংলার বহু পারিবারিক দুর্গাপুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে প্রাচীন ইতিহাস। কালের পরিক্রমায় যা হয়ে ওঠে গর্বের স্মৃতি। নদীয়ার নাকাশিপাড়া ব্লকের বহিরগাছি গ্রামের ভট্টাচার্যবাড়ির দুর্গাপুজোয় রয়েছে তেমনই এক অনন্য ঐতিহ্য। এখানে একই পরিবারের ছয়টি দুর্গাপ্রতিমার পুজো হয়। পুজোর সূচনা করেছিলেন স্বয়ং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের গুরু রামভদ্র ন্যায়লঙ্কার। শুধু তাই নয়, একবার ভট্টাচার্যবাড়িতে মহানবমীর পুজোয় পুরোহিত হয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বহিরগাছি গ্রামের অনেকেই ভট্টাচার্যপাড়াকে ‘দুর্গাপুজো পাড়া’ বলে ডাকেন। প্রায় ২৯১বছরের পুরনো দুর্গাপুজো এখনও তার প্রাচীন মর্যাদা ধরে রেখেছে। এখানে শাক্তমতে দেবীর আরাধনা হয়। এই পুজোর সঙ্গে এলাকার মানুষের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে।
গুরু রামভদ্র ন্যায়লঙ্কারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বহিরগাছিতে পুজোর দালান ও একাধিক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু রামভদ্রের মৃত্যুর পর তাঁর ছয় পুত্র-রঘুরাম, রামরাজ, রামেশ্বর, রামকান্ত, রামহরি ও রামগোবিন্দ-আলাদাভাবে পুজো শুরু করেন। বড় ছেলে বাবার পুজো চালু রাখেন। বাকিরা আলাদা প্রতিমা এনে পুজো শুরু করেন। সেই থেকেই এখানে একই পরিবারের ছয় দুর্গার পুজো হয়। বাংলায় এমন দৃশ্য অত্যন্ত বিরল।
শরিকি পুজোর নানা জটিলতা সত্ত্বেও এই পরিবার পুরনো ঐতিহ্যকে আগলে রেখেছে। ছ’টি পূজামণ্ডপ, ছ’টি প্রতিমা, প্রতিটি পুজোর আলাদা আলাদা আচার-তবু গ্রামের উৎসব ও আনন্দ এক। গ্রামের প্রতিটি মানুষ পুজো ঘিরে যেন একই পরিবারের অংশ হয়ে যান।
এই পুজোর ইতিহাসকে অনন্য গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছে এক মনীষীর আগমন। শোনা যায়, বহুবছর আগে ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্য তথা বর্ধমানরাজের সভাপণ্ডিত মধুসূদন তর্কপঞ্চানন মহানবমীর দিনে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। নবমীর পুজো করার সময় এসে পড়েছে, অথচ পুরোহিত না থাকায় সমস্যা দেখা দেয়। সেসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মধুসূদনবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি নদীয়ায় স্কুল পরিদর্শনে এসে নৌকায় চেপে মধুসূদনবাবুর বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলেন। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর নিজেই আসনে বসে মহানবমীর পুজো সম্পন্ন করেন। এই পরিবারের অষ্টমীর ভোগের বিশেষত্বও উল্লেখযোগ্য। অষ্টমীর ভোগে থাকে ইলিশ মাছ, যা জল ছাড়া সর্ষের তেলে রান্না করা হয়। পরিবারের ভাষায় এর নাম ‘তেলমাছ’। একসময় এখানে মহিষবলি চালু ছিল। পরে তার বদলে ছাগবলি শুরু হয়। এখন শুধু প্রতীকী হিসেবে কুমড়ো বলি হয়।
পরিবারের বড় তরফের বংশধর শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের প্রতিমার সিংহ নরসিংহের মতো দেখতে। এই ছয় দুর্গার পুজো আমাদের গর্ব ও পূর্বপুরুষদের অমূল্য ঐতিহ্য।