• মূক-বধির শুভজিতের তুলিতে জেগে ওঠেন মা
    বর্তমান | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সৌগত গঙ্গোপাধ্যায়  কলকাতা

    টিনের ছাউনির ফাঁকফোকর দিয়ে ঢোকা মৃদু রোদ গোলার নীরবতা ভাঙতে ব্যস্ত। এক কোণে মইয়ের উপর তুলি হাতে বসে তরুণ শিল্পী শুভজিত্। চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি, নিঃশব্দ তাঁর পৃথিবী। ধীরে ধীরে মাতৃপ্রতিমার চোখ আঁকতে শুরু করলেন। নিখুঁত, নীলাভ। মায়ের মুখের দীপ্তি ছাপিয়ে তখন করুণার আনাগোনা। কেন? তাঁর শিল্পীসন্তান যে মূক-বধির। ছেলের কষ্ট মা’ই তো বোঝেন। 

    চারপাশে মজুরেরা ব্যস্ত, ঠুকঠাক আওয়াজ, কেউ আবার গোলা থেকে দুর্গাপ্রতিমা বের করে গাড়িতে চাপাচ্ছেন। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর মহকুমার নান্দাভাঙার ২৭ বছরের তরুণ শুভজিতের কানে সেই শব্দ পৌঁছয় না। আর মুখে নিজের কথাটুকু বলার ক্ষমতাও তাঁর নেই। জন্ম থেকে এই সমস্যা। বহু চিকিত্সা সত্ত্বেও কিচ্ছুটি হয়নি। এমনকী, ভেলোরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সব আশাভঙ্গের শেষে ধ্রুব সত্যি— শুভজিৎ আর পাঁচজনের মতো নয়। তবে বলতে বা শুনতে না পারলেও তাঁর প্রতিভা সংশয়াতীত। ছোট থেকেই সময় কাটত গোলায়। দাদু প্রহ্লাদ সাউ, বাবা রামকৃষ্ণ সাউ নান্দাভাঙার মৃৎশিল্পী। ছেলেকে কাদা ঘাটতে দেখেই প্রতিভার আঁচ পাওয়া। একদিন বাবা দেখেন, আট বছর বয়সেই মায়ের মুখ গড়ে ফেলেছে ছেলে। সেদিনই শুরু হয় শিল্পীর পথ চলা। এখন তো বেশ নামডাক। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দূর-দূরান্ত থেকে অর্ডার আসে। দাদা বরুণ সাউকে সঙ্গে নিয়ে এবার প্রায় ৫০টি দুর্গাপ্রতিমা গড়েছেন। খিদিরপুরের ভেনাস ক্লাবের অকাল বোধনও মূক-বধির শিল্পীর গড়া।

    শুভজিতের স্ত্রী সঙ্গীতাও মূক-বধির। তাঁর ভালোবাসার সঙ্গী। অনুভূতিরও। শব্দ ছাড়াই উপলব্ধির আদানপ্রদান। পরিবারই শুভজিতের বড় শক্তি। ভরসাও বটে। দাদা বরুণ সাউয়ের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে গোলা (গৌরাঙ্গ স্টুডিও) চালান তিনি। মা লেখা সাউয়ের কথায়, ‘ছোটবেলা থেকেই শুভ এমন। পাশে কেউ কথা বললে, ও জানতে চাইত কী বলছে। ইশারায় আক্ষেপ করত, কেন আমি বাকিদের মতো শুনতে, বলতে পারি না। কষ্টে আমার বুক ফেটে যেত। তবে এখন ওর জন্য আমার গর্ব হয়।’ দাদা বরুণ সাউ আবার বলছিলেন, ‘ভাই যখন মাতৃপ্রতিমার চোখ আঁকে, গোলার সবাই কাজ ছেড়ে এসে দেখে। জানেন তো, ও খুব প্রাণবন্ত। মুখে হাসি লেগে আছে। ক্রিকেট খেলা হলে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায় না। আর মোহন বাগান তো মনের খাতায় চিরস্থায়ী।’

    মূক-বধির তো কী হয়েছে? চেরি-তুলির আলপনায় গল্প বলেন শুভজিৎ। তাঁর গড়া প্রতিমায় মাধুর্য রয়েছে, রয়েছে সারল্যও। নীরব অথচ গভীর। ঠিক চার্লি চ্যাপলিনের মতো। তিনিও তো কথা বলেননি। কিন্তু মানুষকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, ভাবতে ব্যধ্য করেছেন। ‘অভিনেতাদের দুর্বলতা ঢাকার সর্বোত্তম মঞ্চ সংলাপ’— শুভজিতকে দেখলে চ্যাপলিনের সেই উক্তি মাথায় আসে। নান্দাভাঙার তরুণেরও ভাষার প্রয়োজন নেই। তাঁর তৈরি প্রতিমা কথা বলে— চোখে, ভঙ্গিমায়, রঙে। কিন্তু আপশোস তো মানবজীবনেরই অঙ্গ। শুভজিৎও ব্যতিক্রম নয়। মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী তাঁকে আলোড়িত করতে পারে না। সেই সময় তিনি ব্যস্ত থাকবেন তাঁর অসুরদলনী তৈরিতে। 
  • Link to this news (বর্তমান)