আজ, বিশ্ব অ্যালঝাইমার’স দিবস। ক্রমবর্ধমান এই রোগ সম্পর্কে পরিবার তথা সমাজের সব স্তরে সচেতনতা বাড়ানোই যার উদ্দেশ্য।
সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব অ্যালঝাইমার’স দিবস পালিত হয়ে থাকে। অ্যালঝাইমার’স রোগে মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে মানুষ ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের শিকার হন। ২০২৩ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুসারে, ভারতে প্রায় ৮৮ লক্ষ ষাটোর্ধ্ব মানুষ ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত। অ্যালঝাইমার’স ছাড়াও আরও অনেক অসুখে স্মৃতিভ্রংশ হয়, তার মধ্যে মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহের ব্যাঘাত বা স্ট্রোক অন্যতম।
প্রতি বছরই এ দেশে স্মৃতিভ্রংশের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যার মূল কারণ গড় আয়ুর বৃদ্ধি। ভারতে এখন জনসংখ্যার ১০.৫ শতাংশের বয়স ষাট বছরের বেশি। সংখ্যার হিসেবে যা ১৫ কোটির কাছাকাছি। ২০৫০-এ এই সংখ্যা প্রায় তিন গুণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনসংখ্যার সঙ্গে বেড়েছে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, জীবনযাপনজনিত সমস্যা এবং পরিবেশ দূষণ। বিশেষত বায়ুদূষণ ডিমেনশিয়া রোগের ঝুঁকি অনেকটা বাড়ায়।
সাম্প্রতিক কালে কমবয়সে অ্যালঝাইমার’স, পার্কিনসন’স রোগ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, যেটা বেশ চিন্তার। অল্পবয়সিদের এই অসুখ বার্ধক্যজনিত অসুখের থেকে কিছু আলাদা। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক তথা জিনঘটিত কারণে কম বয়সে রোগে আক্রান্ত হন। তবে বেশির ভাগ কমবয়সি জিনঘটিত কারণ ছাড়াও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কম বয়সে স্মৃতিভ্রংশ ও পার্কিনসন’স রোগের জন্য বায়ুদূষণ, কীটনাশক, মাইক্রোপ্লাস্টিক ইত্যাদির প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি। এ জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
ডিমেনশিয়া অসুখে রোগী ধীরে ধীরে পরনির্ভর হয়ে পড়েন। যে ওষুধগুলি এখন প্রয়োগ করা হয়, তার দাম খুব বেশি না হলেও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় ওষুধ, পথ্য, পরিচর্যাকারীর বেতন, পরীক্ষার খরচ, ডাক্তারের ফি, যাতায়াতের ভাড়া ইত্যাদির পরোক্ষ খরচ অনেক। কিছু দিনের মধ্যেই কয়েকটি নতুন ওষুধ বাজারে আসতে চলেছে, যেগুলি কার্যকর হলেও মহার্ঘ। রোগীর পরিচর্যা প্রাথমিক পর্যায়ে সহজ হলেও ধীরে ধীরে কঠিন হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনার দরকার হয়।
বহু ক্ষেত্রে এই রোগীরা রাতে জেগে থাকেন। রোগীদের কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে মারধর করেন, যত্র তত্র প্রস্রাব বা পায়খানা করে ফেলেন। কখনও কখনও নিজের মানুষদের সন্দেহ করেন, ব্যবহারে শালীনতা লোপ পায়। অন্যেরা তাতে অপমানিত বোধ করেন। তাই অন্যান্য অসুখের থেকে এই রোগ আলাদা। এই রোগীর সেবার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও সহমর্মিতার।
এ দেশের বিমা সংস্থাগুলি এই চিকিৎসার দায় নেয় না। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে উপার্জনক্ষম করে তুলতেই বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের সঞ্চয় তলানিতে পৌঁছে যায়। কম বয়সে তাঁরা স্বাস্থ্যবিমা ও বয়সকালের জন্য সঞ্চয়ে গুরুত্ব দেন না। অনেকেই পেনশনের আওতার বাইরে। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় তাঁরা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হন। যার ফলে মানসিক জোর কমে যায়। অনেক রোগ থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ব নিতে হয় অসুস্থ স্বামী বা স্ত্রীকে। দীর্ঘ লড়াইয়ে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত এই সব প্রবীণরা অভিমানে বাধ্য হয়ে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন রুজির টানে আটকে পড়া প্রবাসী সন্তানের উপরে। ছেলেমেয়েরা কাছে থাকলেও আধুনিক কর্মজীবন এতটাই চাপের যে তাঁদের ফুরসত হয় না অসুস্থ বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর।
অল্প বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হলে পরিবারের মূল বা একমাত্র উপার্জনকারী অক্ষম হয়ে পড়েন। তাতে সংসারে নেমে আসে চরম দুর্দশা। কমবয়সিদের অনেকের ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া নামক এক প্রকারের অসুখ হয়, যাতে ব্যক্তির সামাজিক ব্যবহারেঅদ্ভুত পরিবর্তন আসে। কী খেতে হয়, কাকে কী বলতে হয়, কোথায় কী করতে নেই— কিছুই আর ঠিক করতে পারেন না। বয়স কম থাকায় শারীরিক ক্ষমতা বেশি থাকে, তাঁকে সামলানোও তখন কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর অসামাজিক ব্যবহারে পরিবারকে লজ্জিত হতে হয় ।
ডিমেনশিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকারি স্তরে হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক চালু একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু আরও কিছু পরিকল্পনা করা খুবই জরুরি। এ বিষয়ে জাপানের থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। প্রতিটি গ্ৰাম ও ওয়ার্ড এলাকায় ডিমেনশিয়া কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজন আছে। অন্যরোগীর ভিড়ে বয়স্ক এবং ডিমেনশিয়া রোগীর চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য হাসপাতাল উপযুক্ত জায়গা নয়। প্রয়োজন আরও পরিকাঠামো এবং অনেক বেশি ডে-কেয়ার ও হসপিস সেন্টার তৈরির। যেখানেসহমর্মিতা-সহ চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে।