আদানি পাওয়ারকে ভাগলপুরে ১,০২০ একর জমি লিজ – বছরে এক একর জমির ভাড়া মাত্র ১ টাকা
আজকাল | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের ভাগলপুর জেলার পীরপাইনতিতে ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য আদানি পাওয়ার লিমিটেডকে রাজ্য সরকার ২৫ বছরের জন্য মোট ১,০২০ একর জমি লিজ দিয়েছে। বিস্ময়করভাবে, এই জমির বার্ষিক ভাড়া ধরা হয়েছে মাত্র এক টাকা প্রতি একর। সরকারের এই সিদ্ধান্তে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা, যাদের অভিযোগ—এখনও অনেকেই জমি অধিগ্রহণের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাননি।
পীরপাইনতি এলাকায় কৃষিজমির একটি বড় অংশ অধিগ্রহণ করা হয়েছিল প্রায় ১২ বছর আগে। স্থানীয়রা দাবি করেছেন, জমিগুলোকে সরকার “অনাবাদী” হিসেবে দেখালেও বাস্তবে এগুলোতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ আম ও লিচুর বাগান, যা কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি আয়ের উৎস ছিল। কৃষকদের বক্তব্য, ক্ষতিপূরণ যে হারে নির্ধারিত হয়েছিল সেই পুরোনো হারেই আজও টাকা দেওয়া হচ্ছে, বর্তমান জমির বাজারমূল্যের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই।
ভুক্তভোগীদের দাবি, সৃজন কেলেঙ্কারির কারণে তাঁদের ক্ষতিপূরণের বড় অংশ কখনও পৌঁছায়নি। প্রায় ২৭০ কোটি টাকা, যা কৃষকদের দেওয়ার কথা ছিল, তা বেআইনিভাবে বেসরকারি এনজিও সৃজন মহিলা সহযোগ সমিতি-র অ্যাকাউন্টে চলে যায়। ফলে বহু পরিবার এখনও বঞ্চিত। কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাগলপুর সফরে গেলে তাঁরা সমস্যার কথা জানাতে চাইলেও পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়।
প্রকল্পের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকা (প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। ১৩ সেপ্টেম্বর আদানি পাওয়ার ও বিহার স্টেট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির মধ্যে ২৫ বছরের জন্য পাওয়ার সাপ্লাই চুক্তি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিনটি ইউনিটে আলাদা আলাদা করে ৮০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিট চালু হতে সময় লাগবে ৪৮ মাস, আর শেষ ইউনিট চালু হবে ৬০ মাসের মধ্যে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৬.০৭৫ টাকা প্রতি ইউনিট দরে রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে সরবরাহ করা হবে।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি হবে বিহারের সর্ববৃহৎ বেসরকারি বিনিয়োগ এবং প্রকল্পটি “আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল, লো-এমিশন প্রযুক্তি”-তে গড়ে তোলা হবে। তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, একই জেলায় আগে থেকেই ২,৩৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের কাহালগাঁও সুপার থার্মাল পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। সেই জায়গায় আরও একটি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নির্মাণ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
বিহার ইতিমধ্যেই বায়ুদূষণের অন্যতম কেন্দ্র। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রাজ্যে প্রায় ২৫০ দিন বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণার (PM2.5) মাত্রা জাতীয় সীমা ছাড়িয়েছে। ভাগলপুর জেলাকে গবেষকরা রাজ্যের দূষণ “হটস্পট”-এর একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া, গঙ্গা অববাহিকায় আর্সেনিক দূষণ একটি বড় সমস্যা। মহাবীর ক্যান্সার সংস্থানের গবেষণায় দেখা গেছে, ভাগলপুর জেলার বহু গ্রামে পানীয় জলে আর্সেনিকের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সীমার বহু গুণ বেশি। এর ফলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুরোগ ও ত্বকের রোগ ব্যাপক হারে দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চালু হলে এই সংকট আরও বাড়বে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে কয়লা ছাড়া অন্য বিকল্প খুঁজতে হবে। বিশেষজ্ঞ শশিধর ঝা জানান, কৃষি জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বা অ্যাগ্রি-পি ভি ব্যবস্থা বিহারের জন্য টেকসই সমাধান হতে পারে। আম ও লিচুর মতো ছায়াসহিষ্ণু ফসলের সঙ্গে মিলিয়ে সৌরপ্যানেল বসানো গেলে কৃষকদের জীবিকা রক্ষা করা সম্ভব হবে, আবার রাজ্যের বিদ্যুতের চাহিদাও পূরণ হবে।
আদানি পাওয়ারকে প্রায় বিনামূল্যে জমি দিয়ে সরকারের এই পদক্ষেপ একদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণের নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষক ও পরিবেশবিদদের কাছে এটি একটি “অনৈতিক চুক্তি” ও ভবিষ্যৎ বিপদের পূর্বাভাস। কৃষিজমি হারিয়ে গ্রামীণ মানুষের জীবিকা যখন সংকটে, তখন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের বদলে নতুন করে উৎপাদন যোগ্য শক্তির উপর গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জোরদার হচ্ছে।