• ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বাদ দেওয়া যায় না কাউকে বলল আদালত ...
    আজকাল | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক বনু মুশতাককে মাইসুরু দশেরা উৎসবের উদ্বোধন থেকে বিরত রাখার দাবিতে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে। শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, ভারতের মতো এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে রাষ্ট্র-আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাদ দেওয়া যায় না। আদালতের মতে, এটি সংবিধানবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।

    এই মামলার শুনানিতে বিচারপতি বিক্রম নাথ ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতা’র দ্বৈত বেঞ্চ তীব্র ভর্ৎসনা করে আবেদনকারীকে সংবিধানের প্রস্তাবনা (Preamble) পড়ার পরামর্শ দেন। বিচারপতি নাথ বলেন, “এটি একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান… রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে A, B বা C কে আলাদা করতে পারে না। সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করা যাবে না।”

    আবেদনকারী এইচ.এস. গৌরব দাবি করেছিলেন, দশরা উৎসবের রিবন-কাটা অনুষ্ঠানটি হয়তো ধর্মনিরপেক্ষ কাজ, কিন্তু চামুণ্ডেশ্বরী মন্দিরে উদ্বোধনী পূজা একটি “অপরিহার্য ধর্মীয় প্রথা” (essential religious practice), যা কোনো অ-হিন্দু করতে পারেন না। তাঁর বক্তব্য, একজন মুসলিম লেখিকা বনু মুশতাককে সেই পূজায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এটি হিন্দু ধর্মীয় প্রথাকে ক্ষুণ্ণ করছে।

    কিন্তু বেঞ্চ এই যুক্তিকে মানতে নারাজ হয়। আদালত স্পষ্ট জানায়, এ ধরণের ভেদাভেদ ভারতের সংবিধান সমর্থন করে না। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর কর্ণাটক হাইকোর্টও একই যুক্তিতে গৌরবের আবেদন খারিজ করেছিল। হাইকোর্ট জানিয়েছিল, বনু মুশতাক একজন কৃতী ব্যক্তিত্ব এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোনো ব্যক্তির অন্য ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করা কোনো সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধিতা করে না।

    সুপ্রিম কোর্টের এদিনের রায় স্পষ্টভাবে পুনরায় মনে করিয়ে দিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের সংবিধানের “মূল বৈশিষ্ট্য” (basic feature)। কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩) এবং এস.আর. বোম্মাই বনাম ভারত সরকার (১৯৯৪)-এর মতো ঐতিহাসিক মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচারপতিদের মতে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব ধর্মের প্রতি সমান আচরণ করা এবং কোনো নাগরিককে তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত না রাখা।

    বনু মুশতাক কর্ণাটকের মাটিতে জন্ম নেওয়া এক প্রথিতযশা লেখিকা। তাঁর উপন্যাস River of Red Earth আন্তর্জাতিক মহলে বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং ২০২১ সালে তিনি বুকার পুরস্কারে ভূষিত হন। সামাজিক অন্তর্দৃষ্টি, নারীর অভিজ্ঞতা, প্রান্তিক জীবনের বয়ান এবং আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থানের প্রশ্ন তাঁর লেখায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। মুশতাককে কর্ণাটকের এক ‘সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন’ হিসেবেও মনে করা হয়, যিনি স্থানীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক  মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁকে মাইসুরু দশরার উদ্বোধনে আমন্ত্রণ জানানোকে রাজ্য সরকার একদিকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে কর্ণাটকের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবেও প্রচার করছে।

    আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় শুধু একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে এটি ধর্মীয় সহাবস্থানকে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে রাজনৈতিক স্বার্থে উৎসবকে ধর্মীয় বিভাজনের হাতিয়ার করার প্রবণতারও কঠোর সমালোচনা করে। এদিনের রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট আবারও স্পষ্ট করে দিল—ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামোয় সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার ও মূল্যবোধই সর্বাগ্রে, কোনো সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা নয়।
  • Link to this news (আজকাল)