সতীর নথ ও নোয়া পরিয়ে দুর্গাপুজো হয় হাটবসন্তপুরের ঘোষাল বাড়িতে
বর্তমান | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মইদুল ইসলাম আরামবাগ
স্বামীর চিতায় সহমরণে যাওয়া সতীর নাকের নথ ও নোয়া পরিয়ে দশভুজার আরাধনা হয় আরামবাগের হাটবসন্তপুরের ঘোষালবাড়িতে। প্রায় ৫৪৭বছর ধরে এখানে এভাবেই দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। এই নথ ও নোয়া আগুনখাকির নথ ও নোয়া নামে পরিচিত। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানে দেবী খুবই জাগ্রত। তাই মনোবাসনা পূরণের জন্য অনেকেই দেবীর কাছে মানত করেন।
ঘোষালবাড়ির সদস্যরা জানালেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ সাধক রামানন্দ এই দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন গোঁসাইমণি। অসুস্থতার জেরে যেদিন রামানন্দ মারা যান, সেদিন তাঁর ভক্তরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেও গোঁসাইমণি লালপাড় শাড়ি, সিঁদুর-আলতা সহ নানা অলঙ্কারে সাজতে শুরু করেন। তাঁর চোখে ছিল না জল। মুখে ছিল প্রশান্তির ভাব। রামানন্দের শবদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় কাঁধে কলসি ও হাতে আম্রপল্লব নিয়ে সবার আগে যান গোঁসাইমণি। বামুনপুকুরের পাড়ে রামানন্দের দেহ চিতায় তোলা হয়। তিনি নিঃসন্তান থাকায় মুখাগ্নির দায়িত্ব পান গোঁসাইমণি। তিনবার প্রদক্ষিণ করে স্বামীর চিতায় মুখাগ্নি করেন গোঁসাইমণি। চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠতেই এলাকা হরধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে স্বামীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন গোঁসাইমণি। কথিত আছে, এঘটনার বছরখানেক পরেই এই বংশে জন্ম নেন অপর এক সাধক কৃষ্ণকান্ত তকর্বাগীশ। তিনি একদিন আরামবাগের ভালিয়া গ্রামে ডাকাতদের কবলে পড়েন। ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি দুর্গানাম জপ করতে শুরু করেন। তখন মহামায়ারূপে গোঁসাইমণি দেখা দিয়ে তাঁকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করেন। এরপর একদিন রাতে কৃষ্ণকান্তকে স্বপ্নে মহামায়া ফের দেখা দেন। তাঁকে বলেন, ‘আমিই তোর বংশে গোঁসাইমণির রূপ ধারণ করে জন্ম নিয়েছিলাম। আমার চিতাভস্ম থেকে একটা সোনার নথ আর একটা রুপোর বাঁধানো নোয়া পাবি। মাটির প্রতিমায় সেই নথ ও নোয়া পরিয়ে বংশানুক্রমে আমার পুজো করলে আমি ওই মাটির প্রতিমায় এসে তোদের ধরা দেব।’ পরদিন সকালে কৃষ্ণকান্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে নথ ও নোয়ার সন্ধানে শ্মশানে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি নথ ও নোয়া খুঁজে পান। এরপর দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন সেই নথ ও নোয়া দেবীপ্রতিমাকে পরিয়ে মহা ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু করা হয়। এবছরও ষষ্ঠীর দিন সেই নথ ও নোয়া দেবীপ্রতিমাকে পরানো হবে।
তখন থেকে এই রীতি অনুসরণ করে ঘোষালবাড়িতে পুজো হয়ে আসছে। প্রতিবছরই এই বাড়িতে ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেবীর আরাধনা করা হয়। ঘোষালবাড়ির সদস্য শৈলেন ঘোষাল বলেন, প্রতিবছরই আমরা ঘটা করে পুরনো রীতি মেনে দশভুজা দুর্গার আরাধনা করি। গ্রামের বাসিন্দারাও এই পুজোয় অংশ নেন। সবাই মিলে পুজোর আনন্দ ভাগ করে নিই। -নিজস্ব চিত্র