• অসম্পূর্ণ আবাসন নিয়ে কড়া নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের, রায় খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ করতে চায় নবান্ন
    আনন্দবাজার | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • মাসের পর মাস ইএমআই দিয়েও মাথায় পাকা ছাদের বন্দোবস্ত করতে পারছে না দেশের মধ্যবিত্ত জনতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আবাসন অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকার কারণেই ভোগান্তি হচ্ছে দেশের মধ্যবিত্ত জনতার। এই সংক্রান্ত বিষয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এই সমস্যা নিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সরকার নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না।

    সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি আর মহাদেবনের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ‘বাসস্থানের অধিকার’ কেবল একটি চুক্তিমূলক বিষয় নয়। এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অঙ্গ। কারণ, বাসস্থান জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই গৃহের ক্রেতাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। দেশ জুড়ে অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবার আজ চরম অনিশ্চয়তার মুখে। জীবনের সঞ্চয়, ঋণ এবং মাসের পর মাসের ইএমআই দিয়ে তারা যে ‘স্বপ্নের বাড়ি’র আশায় বুক বেঁধেছিল, সেই স্বপ্ন আটকে গিয়েছে অসম্পূর্ণ ইমারতের ইট-বালি-সিমেন্টে। সেই বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।

    ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, সরকারকে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বাতিল হয়ে যাওয়া বা মাঝপথে থমকে থাকা প্রকল্পগুলিকে নতুন করে অর্থ সহায়তা দেওয়া যায়। প্রয়োজনে সেগুলি অধিগ্রহণ করে শেষ করার বিষয়ে উদ্যোগীও হতে হবে। আদালতের মতে, সময়মতো প্রকল্প সমাপ্তি ভারতের নগর- নীতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠতে হবে। এ জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রয়োজন, আবাসন নির্মাণকারী সংস্থা যাতে ক্রেতাদের ঠকাতে বা শোষণ করতে না পারে। প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড’-এর ধাঁচে একটি নতুন কর্পোরেট সংস্থা গঠন করতে পারে। আবার চাইলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) মডেলে এমন সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে, যার কাজ হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলিকে শনাক্ত করা, অধিগ্রহণ করা এবং অবশেষে ক্রেতাদের হাতে সমাপ্ত বাড়ি তুলে দেওয়া। এই কাজটি হতে পারে ইনসলভেন্সি ও দেউলিয়া কার্যক্রমের আইনের আওতায়।

    এ ছাড়া আদালত বলেছে, ‘স্পেশ্যাল উইন্ডো ফর অ্যফোরডেবল অ্যান্ড মিড ইনকাম হাউজিং ইনভেন্সমেন্ট’ (এসডব্লিউএএমআইএইচ) তহবিলের পরিসর বাড়ানো যেতে পারে। অথবা ‘ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড’ (এনএআরসিএল)-এর অধীনে একটি বিশেষ পুনরুজ্জীবন তহবিল গড়ে তোলা যেতে পারে, যাতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। তাতে অসম্পূর্ণ প্রকল্প বিষয়ে অনিশ্চয়তা এড়ানো সম্ভব হবে এবং বাড়ি ক্রেতাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে। শীর্ষ আদালত আরও জানিয়েছে, অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারিও জরুরি। প্রকল্পগুলিতে অর্থের অপব্যবহার ঠেকাতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রক মহাপরিদর্শক (সিএজির)-এর দ্বারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পারফরম্যান্স অডিট চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে যেমন স্বচ্ছতা আসবে, তেমনই সরকারের উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়বে।

    কলকাতায় কর্মরত এক আবাসন নির্মাণকারী সংস্থা জানাচ্ছে, দেশ জুড়ে বহু রিয়্যাল এস্টেট প্রকল্প ইতিমধ্যেই দেউলিয়া কার্যক্রমে পড়েছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ পরিবার তাদের স্বপ্নের ঘর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগে এক দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বলেন, ‘‘এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ করার কোনও আইন বা বিধি নেই। তবে রাজ্য সরকার চাইলে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর এই সংক্রান্ত আইনে বদল এনে পুরসভাগুলির হাতে বাড়তি দায়িত্ব দিতেই পারেন।’’

    তবে নবান্নের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইতিমধ্যে রাজ্য সরকাররে এই সংক্রান্ত বিষয়ে একটি কমিটি রয়েছে। যা রাজ্যের আবাসন দফতরের অধীন। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিয়্যাল এস্টেট অথরিটির কাছে এই সংক্রান্ত অভিযোগ জানালে সুরাহা পাওয়া যায়। আবার কোনও ফ্ল্যাটের ক্রেতা যদি ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন, সে ক্ষেত্রে ওই সুবিচার পেতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আবাসন নির্মাণকারী সংস্থাকে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে।

    সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ স্পষ্ট বার্তা বহন করে— বাসস্থান কেবল একটি পণ্য নয়, বরং জীবনযাপনের মৌলিক শর্ত। আর তার সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। দেশে যে হারে রিয়্যাল এস্টেট প্রকল্প থমকে রয়েছে, তার সমাধান করতে দ্রুত পদক্ষেপ করা জরুরি। নইলে প্রতারিত বাড়ি-ক্রেতাদের কষ্ট আরও গভীর হবে। সরকার কত দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ করে এবং সত্যিই মধ্যবিত্তের এই দুঃখ ঘোচাতে পারে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে আইন দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘সবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এসেছে। সেটি দেশের সব রাজ্য সরকারকেই পর্যালোচনা করে দেখেই পদক্ষেপ করতে হবে। তাই এই সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে কিছু বলা অনুচিত হবে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)