• নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে শান্তি শান্তি শান্তি বাজে
    আনন্দবাজার | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • কী রে! বাড়ি চল এ বার! আর কতক্ষণ গঙ্গার ধারে এ ভাবে একা-একা বসে থাকবি! এত কী ভাবছিস বল তো!
    — ‘পঞ্চায়ত’ সিরিজের প্রহ্লাদচার সংলাপটা বারবার মনে পড়ছে।
    — কোন সংলাপ?
    — ওই যে! ‘সময়ের আগে কেউ যাবে না। কেউ না, মানে কেউ না’!
    তা হলে বলতে পারিস, অকালে কেন চলে যায় কেউ?
    — আচ্ছা! একটা কথা বল তো! কোনটা কাল আর কোনটা অকাল, কী ভাবে ঠিক হবে? কে ঠিক করবে?

    পাশের চায়ের দোকান থেকে হঠাৎ ধোঁয়া। কাকলির চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। পাঁচ মাস আগে তুতো-বোনকে হারিয়েছে। কঠিন রোগ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে ওদের গোটা পরিবারের সব চেয়ে প্রাণবন্ত আর আদরের মেয়েটিকে। এত বছরের চেষ্টা আর যুদ্ধ! সব শেষ করে দিয়ে ঠোঁটের কোণে কয়েক ছিটে রক্ত এঁকে অকালমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল মেয়েটি।

    তবে, ছোট থেকে শুনে আসা সেই কথাটা— নিজেকেও অনেক বার বলা কথা— যেটা যখন হওয়ার, সেটা তখনই হয়। তার কী মানে? সময়ের আগে নাকি কখনও কোনও কিছু হয় না। তা হলে ‘অকাল’ শব্দটা কেন? মানেই-বা কী সে ভাবনার?

    অনেক দিন আগে একটি প্রবন্ধে পড়া— ‘অকাল’ শব্দটার অদ্ভুত এবং প্রায়-পরস্পরবিরোধী অর্থ রয়েছে। শব্দটির মধ্যে কখনও এক আকস্মিকতা থাকে, যা চরম আনন্দ দিতে পারে অথবা চরম দুঃখ। অকালমৃত্যু, অকালবৈধব্য। অকালে সম্পর্কের মৃত্যু যদি সেই আকস্মিকতার চরম দুঃখরূপ হয়, তবে প্রবাসী সন্তানের পুজোর আগে অকাল-আগমন, কর্মস্থলে দু’ধাপ টপকে অকাল-পদোন্নতি, অকালে নিঃশব্দ চরণে প্রেমের প্রবেশ— এগুলো মনকে আনন্দ দেয়। তেমনই, বাঙালির জীবনে শরৎকালের এই দুর্গাপুজো সেই আকস্মিক উৎসব উপহার দেয়, যা হয়তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু চিরস্থায়ী এই অকাল-উৎসবের আনন্দের মধ্যে অকালবোধনের পাশাপাশি এক অকালবিজয়ার আবেশও লেগে থাকে।

    আচ্ছা, জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় যে ২৬ জন পর্যটকের অকালমৃত্যু হল, তা অকালবিজয়া নয়? তার মানে, এটাই কি সত্যি যে, প্রতিটি অকাল-হানা, অকালমৃত্যুর সঙ্গে এক বা অনেক অকালবিজয়া জুড়ে রয়েছে? যেমন, মহাভারতে— নবীন অভিমন্যু আর হাজার-হাজার তাজা প্রাণের অকালমৃত্যুর পরেই এক মহতি বিজয়োৎসবের বিজয়া পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন পাণ্ডবেরা! সব অকালের মধ্যেই কি তা হলে নিহিত থাকে বিজয়ার সুর?

    কাকলি বলে উঠল— অতশত জানি না! জানতেও চাই না! বোনের অকালে চলে যাওয়ার পরে, ওর মা-বাবার জীবনে তো আর কোনও অকালসুখ এল না, আসবেও না!
    — কেন? এল তো! জন্মের পর থেকে যন্ত্রণা সহ্য করে আসা তোর বোন কষ্টের জীবন থেকে তো মুক্তি পেল! কষ্টকে হারিয়ে বিজয়ী হল! ভেবে দেখ!

    এই সব পরস্পরবিরোধী আর আকস্মিক অকাল-গোত্রের ভাবনা-কথা-সংলাপের মাঝে কাকলি যেন শুনতে পেল, কে যেন গেয়ে উঠছেন—
    ‘গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে, আর কোলাহল নাই/রহি রহি শুধু সুদূর সিন্ধুর ধ্বনি শুনিবারে পাই/...নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে শান্তি শান্তি শান্তি বাজে/অরূপকান্তি নিরখি অন্তরে মুদিতলোচনে চাই’।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)