আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ২০২৫ সালে পা রাখল তার শতবর্ষে। ১৯২৫ সালে কেশব বালিরাম হেডগেওয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি আজ ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ক্ষমতায় আরএসএসের ভূমিকা এবং তার দীর্ঘদিনের আদর্শগত প্রচেষ্টার ফলাফল প্রকাশ্যে দৃশ্যমান। তবে আরএসএস আসলে কী ভাবনা বহন করে—তা বোঝার জন্য সংগঠনের দ্বিতীয় প্রধান এম. এস. গোলওয়াকরের গ্রন্থ Bunch of Thoughts বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
গোলওয়াকর প্রায় ৩৩ বছর সংগঠনের প্রধান ছিলেন (১৯৪০-১৯৭৩)। তাঁর বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারের সংকলনই Bunch of Thoughts, যা একদিকে দার্শনিক, অন্যদিকে রাজনৈতিক দিকনির্দেশ হিসেবে বিবেচিত। গোলওয়াকর স্পষ্ট করেন যে, সংগঠনটির নাম রাখা হয়েছিল ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’। কারণ, তাঁর মতে, ‘রাষ্ট্রীয়’ মানেই হিন্দু। হিন্দুত্ব ছিল জাতীয়তার একমাত্র সত্তা। তিনি যুক্তি দেন, যদি ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহৃত হতো, তবে তা ভারতীয় সমাজকে বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত বলে মান্য করত। অথচ হেডগেওয়ার এবং গোলওয়াকরের দৃষ্টিতে ভারত ছিল একক ও অবিভাজ্য হিন্দুরাষ্ট্র।
এখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সম্পর্ক নিয়ে গোলওয়াকর তীব্র আপত্তি জানান। তাঁর মতে, সাভারকার নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা একসময় ভুল করেছিল যখন তারা কংগ্রেসকে মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝোতা না করতে বলেছিল, অথচ নিজেদের সেই ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছিল। এতে মুসলিম সমাজকে সমান রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, যা হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণার পরিপন্থী।
ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোতেও গোলওয়াকর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। তাঁর দৃষ্টিতে, ভারতের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হলো এককেন্দ্রিক সরকার। তাঁর যুক্তি ছিল, প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন করা যেতে পারে, কিন্তু আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবলমাত্র একটি কেন্দ্রীয় আইনসভায় থাকা উচিত। এতে গণতন্ত্রও রক্ষা পাবে, আবার জাতীয় ঐক্যও অটুট থাকবে।
তাঁর ভাবনায় ভারতের বিশ্বে অবদান একেবারেই আলাদা। পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজ্ঞানে উন্নত হলেও, আত্মার জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানে তারা পিছিয়ে। গোলওয়াকরের মতে, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম কেবল ঈশ্বরদূত বা শয়তানকে প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু ভারতীয় ঋষি-মুনিরাই সরাসরি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেছেন। তাই ভারতের শক্তি হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যা বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।
কিন্তু গোলওয়াকরের দুঃখ ছিল, আধুনিক যুগে হিন্দু সমাজ পশ্চিমা ভোগবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে নিজস্ব জ্ঞান ভুলে যাচ্ছে। তাঁর মতে, প্রগতিশীলতার নামে যৌন স্বাধীনতা, ভোগ-বিলাস, মদ্যপান, পারিবারিক শৃঙ্খলার অভাব এবং অবাধ সামাজিক মেলামেশা সমাজকে বিপথগামী করছে। এই সব কিছুতে প্রকৃত সুখ নেই, বরং আছে সামাজিক অবক্ষয়।
গোলওয়াকরের মতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে দমিয়ে সমষ্টির মধ্যে আত্মসমর্পণ করাই প্রকৃত সুখের পথ। ব্যক্তির সত্তা বৃহত্তর জাতির মধ্যে মিশে গেলে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা পাবে। আরএসএস তাই একদিকে হিন্দু ঐতিহ্য পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে, অন্যদিকে আধুনিকতার নামে আগত বিপথগামী প্রভাবগুলিকে প্রতিহত করতে চায়।
শতবর্ষ উদ্যাপনের সময় আরএসএসের ভেতরে ও বাইরে আবারও আলোচনায় এসেছে Bunch of Thoughts—যেখানে একদিকে আছে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের আহ্বান। সমালোচকরা বলছেন, এই দর্শন ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রের পরিপন্থী, আবার সমর্থকরা মনে করেন এটি ভারতীয় সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।
আজ আরএসএস যখন শতবর্ষের মাইলফলকে দাঁড়িয়ে, তখন তার অতীত ভাবনা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে নতুন করে বিতর্ক ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতির মূলধারায় যে সংঘের প্রভাব ইতিমধ্যেই গভীর, তার দর্শন ভবিষ্যতে দেশের সমাজ ও সংবিধানকে কোন পথে নিয়ে যাবে—সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়।