এক বার দেখতে শুরু করলে বেরোনো শক্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কখন যে কেটে যাচ্ছে, খেয়ালই থাকছে না! সমাজমাধ্যম জুড়ে ‘রিল’-এর (নিরবচ্ছিন্ন স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিয়ো) ঢেউ এমনই! তৈরি হচ্ছে চরম আসক্তি। ভিডিয়ো গেমের আসক্তি নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, এখন সেই আশঙ্কাই বহু গুণ বেড়েছে রিল নিয়ে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, টানা রিল দেখে চললে অ্যালকোহল বা জুয়ার মতো প্রভাব পড়ে মননে, এতে মস্তিষ্কের ক্ষতির আশঙ্কাও প্রবল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এই প্রভাব যদি তাৎক্ষণিক হয়? যদি এমন স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিয়ো তুলতে গিয়ে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শুটিং করতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বিপদ ঘটে? চিন্তা আরও বাড়ে। সম্প্রতি একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উৎসবের মরসুমে এই চিন্তাই আরও কয়েক গুণ বেড়েছে নানা মহলে। কিন্তু পরিত্রাণের পথ কী, উত্তর মিলছে না।
যেমন, সম্প্রতি নিউ টাউনে একটি মোটরবাইকে সওয়ার হয়েছিলেন তিন জন। এক তরুণের পিছনে দুই তরুণী। কারও মাথাতেই হেলমেট ছিল না। এক তরুণী হাতে ধরা মোবাইলে ‘রিল’ তুলছিলেন। বাইকচালক তো বটেই, তরুণীদের চোখও ছিল সে দিকে। সেই অবস্থায় সরাসরি সামনের একটি সাইকেলে ধাক্কা মারে মোটরবাইকটি। রাস্তায় ছিটকে পড়ে মৃত্যু হয় সাইকেল আরোহীর।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ‘রিল’ তুলতে গিয়েই কখনও চিড়িয়াখানায় জন্তুর সামনে পৌঁছে যাচ্ছেন কেউ, তার জেরে বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে। কেউ আবার হুগলি সেতু থেকে ‘রিল’ তোলার তাড়নায় সরাসরি গঙ্গায় ঝাঁপ দিচ্ছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণরক্ষা হচ্ছে না। একই ভাবে বিপদ ঘটে যাচ্ছে গাড়ির স্টিয়ারিং বা মোটরবাইকের হ্যান্ডল ছেড়ে চালাতে গিয়ে। কখনও নিজেই বিপদে পড়ছেন চালক, কখনও আবার বিপদ ঘটে যাচ্ছে অন্য কারও।
খোঁজ করে জানা যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওড়িশায় কড়াকড়ি করেছে রাজ্য প্রশাসন। সমাজমাধ্যমে নজরদারি চালানো হচ্ছে সেখানে। রাস্তায় এমন রিল তুলতে দেখা গেলেই চালকের লাইসেন্স সাসপেন্ড করার পাশাপাশি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করা হচ্ছে। প্রয়োজনে হাজতবাসের জন্য নির্দিষ্ট ধারায় মামলা করা হচ্ছে। এমন কড়াকড়ি এ রাজ্যে নেই কেন? উৎসবের মরসুমে শুধুই রিল না বানিয়ে নিরাপদে থাকার কথা প্রচার করা হয়। আইনি পথে পদক্ষেপ করা হয় না কেন?
এ ব্যাপারে পরিবহণ দফতরের কর্তাদের দাবি, এ রাজ্যে ‘জয়রাইডের’ (প্রমোদভ্রমণ) অংশ হিসাবেই অপরাধটা দেখা হয়। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর বা অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর মতো ধারাও ব্যবহার করা যেতে পারে। আইনজীবী তথা সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রিলের অপরাধ নিয়ে সরাসরি তেমন আইন না থাকলেও আপত্তিকর, বিশ্বাসে আঘাত লাগার শামিল, উস্কানিমূলক, ষড়যন্ত্রকারী, অপমানজনক ভিডিয়ো হিসাবে দেখে পদক্ষেপ করা যায়।’’ কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তো ‘রিল’ তোলার তাড়নায় বিপজ্জনক ভাবে ভিডিয়ো করা বন্ধ করা যায় না। মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই এক-একটি রিল একটি অ্যালকোহল শটের মতো কাজ করে। ডোপামিন হরমোনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে ব্যাপারটি, যাতে কোনও জ্ঞান-বোধ কাজ করে না। এর মূলে রয়েছে সমাজমাধ্যমে প্রাসঙ্গিক থাকার অদম্য তাড়না। মানুষ ভুলেই যায়, ভার্চুয়াল জগৎ আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য। নিজে সতর্ক না হলে প্রতিকার পাওয়া মুশকিল।’’
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক অফিসার বললেন, ‘‘পুজোর সময়ে এমন রিলের বাড়বাড়ন্তের উপরে আলাদা করে নজর দেওয়া হবে। এমন রিল নিয়ে সমাজমাধ্যমে বিশেষ নজরদারি চালানো হবে। উৎসবের ভিডিয়ো যেন প্রাণঘাতী না হয়।’’