রাহুল চক্রবর্তী, কলকাতা: মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার পর থেকেই ময়ূরের মতো নেচে উঠেছে প্রকৃতি। নীল আকাশে সাদা নয়, মাঝেমধ্যেই কালো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পুজোপ্রেমী বাঙালিকে আটকায় কার সাধ্য। রবীন্দ্রনাথের ‘মোরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটির ভাবনায় সামান্য অদলবদল করে বেরিয়ে পড়েছে অনেকে। সপ্তাহের প্রথম দিন সোমবার সেই ঘটনারই সাক্ষী হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাট। নানা বাহানায় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ঠাকুর দেখা, আর শেষ মুহূর্তের কেনাকাটিতেই ব্যস্ত বাঙালি। এই ছবিতেই আগামী ক’দিন প্রবল জনস্রোতের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
দুর্গাপুজো আর নিছকই পুজো নয়, শিল্পোৎসবও বটে। দু’চোখ ভরে ব্যাপকতা দেখে নিতে মরিয়া প্রত্যেকে। মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে ২০১৫ আগের এক ব্যানার। লালের মধ্যে সাদায় লেখা, ‘এত বড় সত্যি!’ ওই বিজ্ঞাপনই দেশপ্রিয় পার্ককে ভাসিয়ে দিয়েছিল কৌতূহলের বন্যায়। ‘বিশ্বের সব থেকে বড় দুর্গা’র দর্শন যে সেবারই। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে দশ-দশটি বছর। কিশোর হয়েছে যুবক, আর যুবতীরা তরুণী। কিন্তু চমক দিতে ক্লান্তিহীন দেশপ্রিয় পার্ক। এবার ভিড় টানতে তৈরি ১৭০ ফুট লম্বা এবং ৬৫ ফুট উচ্চতার সুবিশাল নৌকা। ব্যানারের লেখাতেও অতীতের ছোঁয়া, ‘দশ বছর পর আবার পুজোর ডেস্টিনেশন।’ তবে এবার অনেক সতর্ক উদ্যোক্তারা। সুবিশাল মণ্ডপ থুড়ি, নৌকা দেখতে মাঠের ভিতরে না ঢুকলেও চলবে। শোনা যাবে জলের আবহ। কাছে গেলে মনে হতেই পারে, ব্রোঞ্জের রঙে রেঙে ওঠা নৌকা চলছে নিজস্ব ছন্দে। কেউ কেউ বলতেই পারেন, মণ্ডপ নৌকা নয়, বজরার মতো। হ্যাঁ, একদমই ঠিক। থাইল্যান্ডের এক বজরার আদলেই তৈরি হয়েছে মা দুর্গার মর্ত্যের ঠিকনা। সঙ্গতে আলোর রোশনাই তো রয়েইছে।
সাধারণত বিশাল মণ্ডপ তৈরি করে অনেক পুজো কমিটিই দর্শক টানার চেষ্টা করে। কিন্তু এতবড় নৌকা এই প্রথম। দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি পাওনা, পুজোর আবেগের স্মৃতি নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র। এবারের থিম শিল্পী রাজু দে। প্রায় ৬০ জন কারিগর মাস তিনেকের যত্নে সাজিয়ে তুলেছেন মণ্ডপ। ভিতরে ঢুকলে বিস্ময় বাড়বে বই তো কমবে না। রাজবাড়ির অন্দরমহল আপনাকে স্বাগত জানাতে তৈরি। দেওয়াল, সিলিংয়ে রঙিন কারুকার্য। ঝলমল করছে ঝাড়বাতি। বিখ্যাত মৃৎশিল্পী পরিমল পালের হাতে তৈরি সাবেকি প্রতিমাও অন্যতম আকর্ষণ। পুজো কমিটির প্রধান কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার বলেন, ‘দেশপ্রিয় পার্ক এবার নতুনের সন্ধানী। পুজোর ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টি করবে আমাদের মণ্ডপ। দর্শনার্থীরা একবার এলে বুঝতে পারবেন দেশপ্রিয় পার্ক কেন সেরা। বড় চমক আর আমরা তো সমার্থক।’
কিন্তু পুজোর ভাবনায় কেন নৌকা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নদ-নদী পুষ্ট বাংলার কথা মাথায় রেখেই শিল্পীরা এগিয়ে চলেছেন। তাঁদেরই একজনের মন্তব্য, ‘প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বন্যা হয়। তখন বাঁচার প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে নৌকা। এবার সেটাই পুজোপ্রেমীরা দেখতে পাবেন দেশপ্রিয় পার্কে। কান পাতলে হয়তো শুনতেও পাবেন কবিগুরুর সেই গান, ‘ওগো, তোরা কে যাবি পারে/ওগো তোরা কে/আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে...’।