ভাসছে খোদ ফিরহাদের পাড়াও! নজিরবিহীন বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত কলকাতা শহরে জনতার কাঠগড়ায় মেয়র হাকিম
আনন্দবাজার | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভাসছে চেতলা। যে চেতলার বাসিন্দা কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম স্বয়ং!
সোমবার রাত থেকে টানা পাঁচ ঘণ্টা যে প্রবল এবং বেনজির বর্ষণ হয়েছে, তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে, ঘটনাচক্রে, দক্ষিণ কলকাতায়। বস্তুত, দক্ষিণ কলকাতায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। তার মধ্যে চেতলায়, মেয়রের পাড়ায় বৃষ্টি হয়েছে ২৬২ মিলিমিটার। এই তথ্য মেয়র ববির নেতৃত্বাধীন পুরসভারই দেওয়া।
ববি শুধু কলকাতার মেয়রই নন, তিনি একই সঙ্গে রাজ্যের পুর এবং নগরোন্নয়ন মন্ত্রীও। ফলে এই বিপর্যয়ের দায় আরও বেশি করে তাঁর উপরেই বর্তাচ্ছে। ভুক্তভোগী জনতার একটি বড় অংশের কাঠগড়ায় মেয়র নিজেই। সোমবার সারা রাত প্রবল বর্ষণের সময়েই ববি তাঁর চেতলার বাড়ি থেকে পুর প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। কিন্তু লকগেট বন্ধ থাকায় এবং বৃষ্টি বিরাম না নেওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। মেয়র দ্রুত যোগাযোগ করেন পুরসভার মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহের সঙ্গে। পুরসভার কন্ট্রোল রুমেও যোগাযোগ করেন তিনি। তড়িঘড়ি টি-শার্ট চাপিয়ে এবং ট্রাউজ়ার্স গুটিয়ে জল ভেঙে পৌঁছোন পুরসভায়। কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে।
মঙ্গলবার ভোর থেকে জলবন্দি হয়ে পড়ে গোটা কলকাতা। পোর্টেবল পাম্প চালিয়ে প্রাথমিক ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রাতভর বৃষ্টির দাপট কমেনি। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, এক রাতের বৃষ্টিতে নাকাল এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা শহর। জনজীবন প্রায় স্তব্ধ। পুজোর মুখে বানভাসি কলকাতার অভিযোগের আঙুল স্বভাবতই উঠতে শুরু করেছে কলকাতার মেয়রের দিকে।
কলকাতার মেয়র পদ থেকে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আকস্মিক ইস্তফার পরে তাঁর অন্যতম আস্থাভাজন ববিকে কলকাতার মেয়র পদে নিয়ে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে কারণে তাঁকে বিধানসভায় আলাদা বিলও আনতে হয়েছিল। তখন থেকেই মেয়র এবং পুরমন্ত্রীর যৌথ দায়িত্ব পালন করছেন ববি। শাসকদলের অন্দরে অনেকেই তখন বলেছিলেন, একই সঙ্গে দু’টি দায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। কারণ, প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়াও ববির একাধিক রাজনৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলার দায়িত্ব তাঁর উপর। দায়িত্ব ছিল হিডকোরও। সে দায়িত্ব সম্প্রতি মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উপরে ন্যস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে ববি মেয়র হিসাবেই ‘স্বচ্ছন্দ’। বস্তুত, এর আগে একবার তৃণমূলে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি চালু করার সময় ববিকে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। তাঁকে মন্ত্রী বা মেয়র যে কোনও একটি পদ ছাড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, প্রয়োজনে ববি মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু মেয়রের পদ তিনি ছাড়তে রাজি হননি। শেষপর্যন্ত অবশ্য তাঁকে কোনও পদই ছাড়তে হয়নি। কিন্তু কলকাতার মেয়রের পদ তাঁকে বারবার বিড়ম্বনায় ফেলেছে। যার শেষতমটি হল সোমবারের রাতভর বেনজির বৃষ্টি।
রাজ্য প্রশাসন এবং শাসকদলের অন্দরে যাঁরা ববির সমালোচক, তাঁরা বারংবার প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং ববির অব্যবহিত আগের মেয়র শোভনের সঙ্গে তাঁর তুলনা করেন। সেই নিন্দকদের মতে, মেয়র হিসাবে ববি তাঁর দুই দলীয় সতীর্থের চেয়ে খানিকটা পিছিয়েই রয়েছেন। যদিও ববির হিতৈষীদের বক্তব্য, মেয়র হিসাবে জনগণের সঙ্গে সংযোগে ববি তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাঁর আমলেই সরাসরি নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ শোনার এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সাপ্তাহিক ‘টক টু মেয়র’ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। তিনি মেয়র হিসাবে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগে থাকেন। যদিও পরিস্থিতির ফেরে ববি সেই জনতারই কাঠগড়ায়!
সোমবার সারা রাত নজিরবিহীন বৃষ্টি হয়েছে মেনে নিয়েও শহরবাসীদের বড় অংশ জল না নামার জন্য কলকাতা পুরসভার নিকাশিব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। তাঁদের অভিযোগ, পুরসভার বিভিন্ন বিভাগ বছরের বাকি সময় ঠিকঠাক কাজ করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। আবার অনেকে আঙুল তুলছেন সামগ্রিক ‘টাউন প্ল্যানিং’এর প্রতি। যদিও কলকাতার মতো একটি শতাব্দীপ্রাচীন শহরে, যা একেবারেই পরিকল্পনাহীন ভাবে বেড়ে উঠেছে, কোনও পরিকল্পনাই নতুন করা করে ওঠা যাবে না। ফলে সে ‘দায়’ মেয়র হাকিমের নয়। তবে নিকাশির দায় নিশ্চিত ভাবেই মেয়র এবং তাঁর পরিচালনাধীন পুরসভার উপর বর্তায়।
কলকাতার অবস্থান একটি কড়াইয়ের মতো হওয়ায় বৃষ্টি হলে জল জমা এই শহরের নাগরিকদের ভাগ্যলিপি। কিন্তু সেই জমা জল দ্রুত যাতে বেরিয়ে যায়, তার পরিকল্পনা করা নগর প্রশাসকদের উপরেই নির্ভরশীল। সে কাজে ববির নেতৃত্বাধীন পুরসভা কতটা সফল, এই বিপর্যয়ের পরে নাগরিকদের প্রশ্ন সেটাই।
ঘটনাচক্রে, বিধানসভা ভোটের আর এক বছরও বাকি নেই। স্বভাবতই বিরোধী বিজেপি মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক আক্রমণে নামবে। তারাও কাঠগড়ায় তুলবে মেয়রকেই। বস্তুত, বিজেপির একটি অংশ মেয়র পদ থেকে ববিকে সরানোর দাবি তোলার কথাও ভাবছে বলে খবর। বিরোধী শিবিরের অনেকের বক্তব্য, শহরে বিজেপি সম্পর্কে ‘ছুঁতমার্গ’ থাকায় অনেকেই বাধ্য হয়ে তৃণমূলের পাশে থাকেন। কিন্তু শহর যখন বিপর্যস্ত, তখন তাঁদেরই ‘বোধোদয়’ হতে পারে। বিরোধী রাজনৈতিক দল হওয়ার সুবাদে এই পরিস্থিতির ফয়দা তুলতে হবে।
বিধানসভা ভোটের আগে কলকাতা শহরের এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল যে বিড়ম্বনায় পড়বে, তা দলের নেতারা একান্ত আলোচনায় গোপন করছেন না। শাসকদলের প্রথম সারির এক নেতার বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের তিন জন কলকাতার মেয়রের দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁদের মধ্যে সুব্রতদা (প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়) এবং শোভনদা (শোভন চট্টোপাধ্যায়) পুরসভার ইতিহাসে সেরা দুই মেয়র। এমনও দেখেছি, সুব্রতদা পুরসভার কাজের জন্য দলের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। আবার শোভনদা ঝগড়া না-করে দলকে বুঝিয়ে সবটা করতেন। কিন্তু পুরসভার কাজে ববিদার সেই পারদর্শিতা নেই।’’
শাসকদলের একাংশের অভিমত, কলকাতার মেয়র, রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী এবং দলেরও প্রথম সারির নেতা ববি। তৃণমূলে পর্যবেক্ষক মডেল উঠে গেলেও ববি বিভিন্ন জেলা সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় রাখেন। দায়িত্বের এই ‘বোঝা’ কলকাতার মেয়র হিসাবে তাঁর ব্যর্থতাকে প্রকট করে দিচ্ছে! কিন্তু তা ছাড়াও আরও কিছু ব্যাখ্যা উঠে আসছে তৃণমূল নেতাদের কথায়। এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে ববি নিরুপায়। উনি নিজে মেয়র হলেও কলকাতার বিভিন্ন অংশে তিনি কোনও ভূমিকা নিতে পারেন না। কারণ, এমন অনেক ওজনদার নেতা তৈরি হয়েছে, যারা নিজেদের এলাকায় নিজেরা মেয়র।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘এখন তৃণমূলে দু’টি বিষয় বজায় রাখতে হয়। এক, উপরের স্তরের নেতৃত্বকে খুশি রাখতে হবে। আবার নিচুতলাকেও চটানো যাবে না। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে অনেককেই শাঁখের করাতে পড়তে হচ্ছে। ববির ক্ষেত্রেও তেমন হচ্ছে।’’
শাসকদলের কেউ কেউ অর্থের সংস্থানের প্রসঙ্গও তুলছেন। কলকাতার বাসিন্দা কিন্তু ভিন্ন এলাকার এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘‘পুরসভার পরিকাঠামোগত কাজের পরিচর্যা করার জন্য যে প্রয়োজনীয় অর্থ দরকার, তার অভাব রয়েছে। জোড়াতাপ্পি দিয়ে কাজ চলছে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে উপায় থাকছে না।’’
প্রশাসনের একাংশের মতে, যে কোনও সরকারের ক্ষেত্রেই নিয়োগগুলি ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে করা হয়। সেটাই দস্তুর। কিন্তু রাজনীতির পাশাপাশি ‘দক্ষ’ প্রশাসক হওয়ার বিষয়টিও নিয়োগের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা জরুরি।
আদিগঙ্গার নিকটস্থ হওয়ায় মেয়রের পাড়া চেতলায় বরাবরই জল জমার সমস্যা ছিল। ববি জল জমা আটকাতে না পারলেও জমা জল বেরোনোর পথ সুগম করেছিলেন। ফলে চেতলার ‘উত্তরণ’ হয়েছিল। মঙ্গলবার সেই চেতলার বাড়ি থেকেই মেয়রকে বেরোতে হল হাঁটু পর্যন্ত ট্রাউজ়ার্স গুটিয়ে!