• পর্বতের মতো উঁচু তাঁর জেদ, বাড়ি বন্ধক রেখে ছুঁয়েছিলেন এভারেস্ট, হার না মানা এক শিক্ষিকার কাহিনি ...
    আজকাল | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: অপরিসীম সাহস, অদম্য মনোবল ও অসীম অধ্যবসায়ে মাউন্ট এভারেস্টের শিখরে পৌঁছেছিলেন নদিয়ার রানাঘাটের স্কুল শিক্ষিকা রুম্পা দাস। ৮,৮৪৯ মিটার উচ্চতার পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন পূরণে তিনি বন্ধক রেখেছিলেন নিজের বাড়ি। নিজে থেকেই নিয়েছেন বিপুল ঋণের বোঝা। তাঁর এই সাফল্য প্রমাণ করেছে জীবনে দৃঢ় সংকল্প থাকলে একজন মানুষ কত উঁচুতে পৌঁছতে পারে। গর্বিত গোটা নদিয়া, গর্বিত গোটা রাজ্য।

    রানাঘাট পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুম্পা ছোটবেলা থেকেই পাহাড়প্রেমী। স্বপ্ন ছিল একদিন এভারেস্টে উঠবেন। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের পথ মোটেই সহজ ছিল না। বারবার বাধ সেধেছে আর্থিক প্রতিকূলতা। সেই সময়ে বহু মানুষের কাছে নিজের জন্য দরবার করেছিলেন। তবুও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। বাধ্য হয়েই বাড়ি বন্ধক রেখেই এভারেস্ট ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। 

    শেষপর্যন্ত নিজের দু’তলা বাড়ি বন্ধক রেখে রানাঘাটের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন প্রস্তুতি। বর্তমানে তাঁর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে ৫৬ হাজার টাকা সুদ মেটাতে হচ্ছে তাঁকে। স্কুলের চাকরির বেতনের প্রায় পুরো অংশই চলে যাচ্ছে ঋণের কিস্তি দিতে। এত বড় ঋণের বোঝা সামলাতে তাঁকে যথেষ্টই সহায়তা করেছেন তাঁর স্বামী সুমন বসু। তিনি নিজেও একজন বেসরকারি সংস্থার কর্মী‌। প্রতি বছর টাকা পয়সা একটু একটু করে জমিয়ে একেকটি শৃঙ্গ জয় করে ফিরেছেন নিজে থেকেই। এবারে বড় পদক্ষেপ নিতে গেলে তাঁকে বাধ্য হয়েই ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হতে হয়। 

    চলতি বছরের ৩১ মার্চ রুম্পা যাত্রা শুরু করেন। ১ এপ্রিল পৌঁছন কাঠমান্ডু। ৪ এপ্রিল শুরু হয় ট্রেকিং। ১১ এপ্রিল পৌঁছন বেস ক্যাম্পে। সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ১০ মে শুরু হয় সামিট পুশ। ১৪ মে রাতে ক্যাম্প ৪ থেকে যাত্রা শুরু করে, ১৫ মে সকালে অবশেষে তিনি পৌঁছন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। তবে তাঁর এই জয়যাত্রা শুধুই আনন্দের নয়, রয়ে গেছে গভীর এক বেদনার ছাপ। অভিযানের সঙ্গী সুব্রত ঘোষ এভারেস্টে প্রাণ হারান। সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় রুম্পাকে।

    পেশায় স্কুল শিক্ষিকা হলেও রুম্পা একজন প্রশিক্ষিত পর্বতারোহী। ২০১৫ সালে ‘ম্যাক’ (Mountaineers Association of Krishnanagar)-এর সদস্য হয়ে শুরু করেন পর্বতারোহণের অভিযান। এরপর জয় করেন অরুণাচলের গরিচেন-সহ মোট ১২টি শৃঙ্গ। মাউন্ট এভারেস্ট ছিল তাঁর ১৩তম অভিযান। ২০২১ সালেও তিনি এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করেছিলেন, তবে শারীরিক অসুস্থতা ও শ্বাসকষ্টের কারণে মাঝপথেই ফিরে আসতে হয়। তবু হাল না ছেড়ে দ্বিতীয়বারে সফল হন। রুম্পার পাশে সবসময় থেকেছেন তাঁর স্বামী সুমন বসু। সংসার ও স্বপ্নের টানাপোড়েনে থেকেও তাঁরা একে অপরের পরিপূরক। তবে এত বড় সাফল্য অর্জনের পরও আর্থিক দিক থেকে কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পাননি রুম্পা। ভবিষ্যতে মানাসলু অভিযানে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও অর্থের জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।

    তাঁর কথায়, 'আমি জানি লড়াই এখনও শেষ হয়নি। মানসিক শক্তি আর স্বপ্ন থাকলে সব কিছুই সম্ভব। আমার জয় উৎসর্গ করছি তাঁদের, যারা সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে নিজেরা নিজেদের পথ খুঁজে নিতে চায়।' স্থানীয় প্রশাসন ও কিছু সমাজবাসী তাঁকে সংবর্ধনা জানালেও দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা এখনও অধরা। নদিয়া তথা রাজ্যবাসীর দাবি, এই ধরনের সাহসী নারীর পাশে সরকার যেন অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে।

    রুম্পা দাস আজ শুধুমাত্র একজন পর্বতারোহী নন, তিনি নারী শক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর জীবনকথা ভবিষ্যতের অনেক তরুণীকে স্বপ্ন দেখতে এবং সেই স্বপ্ন পূরণে লড়তে অনুপ্রাণিত করবে, নিঃসন্দেহে।
  • Link to this news (আজকাল)