‘মেঘভাঙা’ না হলেও ৪০ বছরের নজিরভাঙা বৃষ্টি, মৃত্যু ১০ জনের! রাত পর্যন্তও জলমগ্ন বহু এলাকা, বড় সমস্যায় পুজো উদ্যোক্তারা
আনন্দবাজার | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ধীরে ধীরে জল নামছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। তার মধ্যেই নতুন দুঃসংবাদ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুর্যোগঘটিত কারণে মৃত্যু হয়েছে আরও এক জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু কলকাতায় মৃত্যু হল নয় জনের। লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগনা ধরলে দুর্যোগে প্রাণ হারালেন ১০ জন। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, দ্বিতীয়ায় ‘রেকর্ড’ করে ফেলেছে কলকাতার বৃষ্টি। ৩৯ বছর পর এক দিনে এতটা বৃষ্টি ঝরল কলকাতায়। দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটেনি। পুরসভা এবং রাজ্য সরকার জানাচ্ছে, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জনজীবন। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, সরকার তথা এই প্রশাসন কতটা অযোগ্য তা বুঝিয়ে দিয়েছে মাত্র ৬ ঘণ্টার বৃষ্টি!
হাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টির নিরিখে এ বারের ২৩ তারিখ তৃতীয় স্থান ‘অধিকার’ করেছে। ১৯৭৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় গড়ে ৩৬৯.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। তার পর ১৯৮৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। সে দিন ২৫৯.৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। তার পর এ বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর— ২৫১.৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যার বেশির ভাগ মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে। ফলে ৩৯ বছর পর এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হল। সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত। অন্য দিকে, সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির মাস ধরলে এ বছরের সেপ্টেম্বর রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। প্রথমেই ১৯৭৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তার পরে ১৯০৮ সালের ১৮ জুন। সে দিন ৩০৩.৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল কলকাতায়।
আরও একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে মৌসম ভবন। সেটা হল গত তিন সপ্তাহে কলকাতায় যা বৃষ্টি হয়েছে, তার থেকে ৬৯.৯ মিলিমিটার বেশি হয়েছে শেষ ২৪ ঘণ্টায়। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কলকাতায় ১৭৮.৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শহরে বৃষ্টির পরিমাণ ২৪৭.৪ মিলিমিটার! রাতভর ভারী বর্ষণে কলকাতায় জল জমেছে এমন জায়গায় যেগুলোয় অন্য বৃষ্টির দিন জমে না। শহরের প্রায় প্রত্যেকটি হাসপাতালেই জল জমেছিল। গণপরিবহণ পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ায় অন্যান্য জায়গার মতো হাসপাতালের কর্মীদের বড় অংশ মঙ্গলবার কর্মস্থলে পৌঁছোতে পারেননি। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, এনআরএস সর্বত্রই একই পরিস্থিতি। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। আগাম ছুটি ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।
মেঘভাঙা না হতেই এত!
পুজোর মাসে এমন দুর্যোগে অনেকেরই দাবি মেঘভাঙা বৃষ্টি (ক্লাউডবার্স্ট) হয়েছে কলকাতায়। আবহাওয়া দফতর অবশ্য ওই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। তারা জানাচ্ছে, এক ঘণ্টায় ২ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টি হলেই এই প্রবল বর্ষণকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা যেত। সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হলে তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা হয়। কলকাতায় রাত ৩টে থেকে ভোর ৪টের মধ্যে এক ঘণ্টায় ৯৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সামান্য বৃষ্টি হলেই মেঘভাঙা বৃষ্টির ‘নজির’ হত কলকাতায়।
৬ ঘণ্টা নিল ৯ প্রাণ!
সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতায়। তাতেই নয় নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এঁদের কেউ বাজ পড়ে মারা যাননি। প্রাণহানির কারণ, বৃষ্টির জমা জল পার হতে গিয়ে তড়িদাহত হওয়া। বৃষ্টির কলকাতায় পথবাতি, ট্রান্সফর্মার থেকে আগেও বহু বিপদ হয়েছে। সেই ‘ধারা’ বজায় থাকল ২৩ সেপ্টেম্বরেও। সরকারি তথ্যই বলছে, নয় জনের নয় জনই তড়িদাহত হয়ে মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাত জন জলবন্দি রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অকালে প্রাণ হারালেন। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন বছর পঁচিশের এক তরতাজা যুবকও। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গড়িয়ার মহামায়াপুর স্কুল রোডের বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ বর্মণ মারা গিয়েছেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। পরিবার সূত্রে খবর, ৩৪ বছরের যুবক যে এলাকায় থাকেন, সকাল থেকে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। ইন্দ্রজিৎ সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন পাশে বন্ধুর ফ্ল্যাটে। সেই আবাসনের গেট স্পর্শ করতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান তিনি।
হাওয়ার খবর নেই অফিসে!
বৃষ্টির সতর্কতা ছিলই। কিন্তু এত বৃষ্টি হবে ভাবতে পারেনি আবহাওয়া দফতরও। খামখেয়ালি বৃষ্টি অবাক করে দিয়েছে আবহবিদদেরও। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের আঞ্চলিক অধিকর্তা হাবিবুর রহমান বিশ্বাস জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত কলকাতায় খানিক অস্বাভাবিক বৃষ্টিই হয়েছে। তবে এই ঘটনা নজিরবিহীন নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিলই। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় কলকাতায় ২৫১.৪ মিলিমিটার (অতি ভারী) বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টি দেখে অবাক মেয়র!
“আমি কলকাতায় জন্মেছি। এত বড় হয়েছি। এমন বৃষ্টি দেখিনি। আজ সেটা দেখলাম কলকাতায়।” বক্তা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। এক রাতে ৩০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে জেনে বিস্মিত মেয়র বলেন, “এটি একটি ভয়াবহ বৃষ্টি।’’ শহরের জলমগ্ন পরিস্থিতির কথা মেনে নিয়েও মেয়র বোঝাতে চান, তিনি অপারগ। তিনি জানান, গঙ্গায় জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছে। নিকাশি খালগুলি কানায় কানায় পূর্ণ। তার উপরে দুপুরে গঙ্গায় জোয়ার। ফিরহাদ জানান, কলকাতার পাম্পিং স্টেশনগুলিতে জলের পাইপ দিয়ে ঘণ্টায় ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে জল বার করা যেতে পারে। সেখানে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টির জল বেরোতে স্বাভাবিক ভাবেই সময় লাগার কথা। তিনি জানান, জল নামবে, তবে ধীরে ধীরে। রাতে অবশ্য জলবন্দি বহু এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।
নাজেহাল নাগরিক
সকাল থেকে ভাঙাপথে পরিষেবা চলেছে কলকাতা মেট্রোর ব্লু লাইনে (দক্ষিণেশ্বর-শহিদ ক্ষুদিরাম)। বিকেলের পর থেকে পরিষেবা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানান মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাতেও এক-একটি স্টেশনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। ওই যাত্রীদের বেশির ভাগই বিস্তর দুর্ভোগ পোয়ানোর পরে গন্তব্যে গিয়েছেন।
সকাল থেকে একের পর এক সরকারি এবং বেসরকারি রুটে বাস বন্ধ ছিল। যে ক’টি বাস রাস্তায় নেমেছে, তাদের সিংহভাগ গন্তব্যে পৌঁছে স্ট্যান্ডে ফিরেছে দীর্ঘ ক্ষণ বাদে। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অফিসের রাস্তা ধরলেও ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। গড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে যাদবপুর এইটবি, বেলা যত বেড়েছে, বাসের সংখ্যা কমেছে। তত দীর্ঘ হয়েছে প্রতীক্ষারত যাত্রীদের লাইন। অনলাইন ক্যাব ভাড়া করতে গিয়েও নাজেহাল দশা। হয় ‘বুকিং’ নিচ্ছে না, নয়তো নিলেও আকাশছোঁয়া ভাড়া চাওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় অটো ধরতে গিয়ে আর এক বিস্ময়! যে যেমন খুশি ভাড়়া চেয়েছেন। বিভিন্ন অটো রুটে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে যাত্রীদের। যে রাস্তায় সপ্তাহের বাকি ছ’দিন ১৮ টাকা ভাড়া দিয়েছেন, মঙ্গলবার সেই দূরত্ব পার করতেই খসাতে হয়েছে দেড়শো থেকে দু’শো টাকা। তার উপর গন্তব্য থেকে খানিক দূরে নামিয়ে অটো চলে গিয়েছে পরের ‘টিপ’-এ। ভাঙাপথে কর্মস্থলে যখন পৌঁছোতে অনেকেরই দুপুর হয়ে যায়। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা, সর্বত্রই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে নিত্যযাত্রীদের।
বিপর্যস্ত রেল পরিষেবা
কলকাতা এবং শহরতলিতে রাতভর নাগাড়ে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত রেল পরিষেবা। শিয়ালদহ এবং হাওড়া স্টেশনের কাছে রেললাইনে জল জমে যায়। তার জেরে সকাল থেকে ব্যাহত হয় ট্রেন চলাচল। পরে শিয়ালদহ মেন ও উত্তর শাখা এবং হাওড়া শাখায় সম্পূর্ণ পথে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও পরিষেবা ছিল অনিয়মিত। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় সন্ধ্যা ৭টার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।
শিয়ালদহ শাখায় লাইনে জল জমে থাকার কারণে চক্ররেলের আপ এবং ডাউন লাইনের পরিষেবা আপাতত বন্ধ রয়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন পরিষেবা। শিয়ালদহ থেকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেনগুলি বালিগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রেলের তরফে জানানো হয়েছে, শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখাতেও দ্রুত পরিষেবা স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। ৭টা নাগাদ বলা হয়, পরিষেবা এখন স্বাভাবিক।
বাতিল উড়ান
ভারী বৃষ্টি আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জেরে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ৩০টি বিমান বাতিল হয়েছে মঙ্গলবার। সকাল থেকেই বিমান ওঠানামায় দেরি হচ্ছিল। বহু বিমান নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে পারেনি। বিস্তর দুর্ভোগ পোয়াতে হয় যাত্রীদের। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়, দুর্যোগের জেরে অনেক পাইলট ও ক্রু সদস্য সময়মতো পৌঁছোতে পারেননি বিমানবন্দরে। ফলে কিছু বিমান বাতিল করতে হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর রোষে সিইএসসি
এক দিনের দুর্যোগে কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুষলেন সিইএসসি-কে। তিনি বলেন, ‘‘জরুরি ভিত্তিতে কর্মীদের নামাক (ওরা)।” বেসরকারি ওই বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “এখানে ব্যবসা করছে। আর পরিকাঠামো আধুনিকীকরণের (মডার্নাইজ়েশন) কাজ করছে রাজস্থানে! মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্য সরকারের পাশাপাশি সিইএসসি-কেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মমতার কথায়, ‘‘জীবনের কোনও বিকল্প হয় না। তবুও আমরা মৃতদের পরিবারের এক জনের চাকরি নিশ্চিত করব। সিইএসসি-কে বলেছি ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে।’’ সিইএসসি কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েন্কার সঙ্গেও তাঁর কথাও হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, ডিভিসিকে তোপ দেগে সমাজমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, “এক তরফা জল ছাড়ায় রাজ্য এমনিতেই প্লাবিত ছিল, নদী, খাল সব টইটম্বুর ছিল। ফরাক্কা জলাধার দিয়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশের প্রচুর জল আসছে, সেখানে ড্রেজ়িং না-হওয়ায় সমস্যা তো ছিলই । তার ওপরে এল এই হঠাৎ বিপুল বৃষ্টি।”
মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় মেট্রো
বেনজির বৃষ্টিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জলমগ্ন ছিল সল্টলেক, রাজারহাট, নিউ টাউনের বিভিন্ন এলাকা। হিডকো এবং এনকেডিএ-র সেই সমস্ত এলাকা জলমগ্ন থাকার দায় মেট্রো কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, মেট্রোর কাজকর্মের জন্য সল্টলেক ও নিউ টাউনের বিভিন্ন জায়গায় মালপত্র পড়ে রয়েছে। তার ফলে বুজে রয়েছে নালা-নর্দমা। সেই কারণেই জমা জল নামছে না। মমতার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মেট্রো কর্তৃপক্ষ কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি।
বাজল ছুটির ঘণ্টা
মঙ্গলবার দুপুরেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ঘোষণা করেছেন পুজোর ছুটি এগিয়ে আনা হচ্ছে। স্কুল এবং সমস্ত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর থেকেই। এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুজোর ছুটি দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি এমনই হল যে মঙ্গলবার কলকাতা ও সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করতে হয়েছে। বাতিল হয়েছে বেশ কিছু পরীক্ষাও। এরই মধ্যে রাজ্য সরকারের তরফে পুজোর ছুটি তিন দিন এগিয়ে আনার ঘোষণা করে দেওয়া হল।
বন্ধ বিচার!
টানা বৃষ্টিতে মঙ্গলবার বন্ধ থাকল কলকাতা হাই কোর্ট। দুপুর ২টো নাগাদ কয়েক জন বিচারপতি শুনানির কাজ শুরু করার জন্য এজলাসে গিয়েছিলেন। ছিলেন কর্মচারীরাও। কিন্তু আইনজীবীদের পাওয়া যায়নি। ভারী বৃষ্টির জেরে আইনজীবীরা আদালতে আসতে পারেননি, এই মর্মে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে শুনানির কাজ স্থগিত রাখার আবেদন জানায় আইনজীবীদের তিনটি সংগঠন। তাঁদের অনুরোধ, যে সব মামলায় সব পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত রয়েছেন, শুধুমাত্র সেগুলির শুনানি করা হোক। তবে যে মামলাগুলির শুনানি হল না, সেগুলি যেন তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া না হয়। হাই কোর্ট সূত্রে খবর, সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।
পুজোর ঢাকে বৃষ্টি
পুজোর ঢাকে কাঠি না-পড়তে পড়তেই দ্বিতীয়া ভিজল বৃষ্টিতে। কলকাতার অধিকাংশ বড় মণ্ডপ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মহালয়াতেই। কিন্তু রাতভর বৃষ্টিতেই সব ভিজে চুপচুপে। বানভাসি শহরের কোথাও ভেঙে পড়েছে মণ্ডপের একাংশ, কোথাও প্যান্ডেলের ভিতরে জমেছে হাঁটুজল। শারদোৎসবের শুরুতেই নজিরবিহীন বৃষ্টি এর আগে দেখেনি কলকাতা। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে সময়ে প্যান্ডেলের কাজ শেষ হবে, তাই নিয়ে ভাবনা বেড়েছে পুজো কমিটির কর্তাদের। কপালে চিন্তার ভাঁজ পটুয়াপাড়াতেও। কারণ, বড় পুজো মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা পৌঁছে গেলেও বহু বারোয়ারি এবং আবাসনের পুজোর প্রতিমা এখনও কুমোরটুলিতে। কাজ শেষের সময় আবার কাজ বেড়ে গেল তাঁদের। অন্য দিকে, পুজোর কেনাকাটাও মাটি হয়েছে। পুজোর মরসুমে সারাদিন তেমন বিক্রিবাটা হয়নি।
আঁধারে সল্টলেক
সল্টলেক-সহ বিধাননগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাত পর্যন্ত কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও কোমর ছুঁইছুঁই জল রয়েছে। পাম্পের সাহায্যে জল নামানোর কাজ চলছে। কোথাও আবার জল ঠেলেই মন্থর গতিতে চলছে গাড়ি। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে বিধাননগর পুরসভা জানিয়ে দেয় সল্টলেকের অলিগলিতে সমস্ত পথবাতি বন্ধ থাকবে মঙ্গলবার। জল না-নামা পর্যন্ত আলো জ্বলবে না সল্টলেকের কোনও রাস্তায়। হলও তাই। এখন দেখার বুধবার আলো জ্বলে কি না।
নবান্নের নজর
রাতভর এমন ভারী বৃষ্টির পরে মঙ্গলবার সাধারণ মানুষকে বাড়ি থেকে না বেরনোর পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র। রাস্তায় নেমে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মানুষজন। গাড়ি পেতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। বৃষ্টির ঝাপটা খেতে খেতে অটোয় চাপলেও মাঝপথে আর কোনও গাড়ি না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার পর জমা জলে একের পর এক দুর্ঘটনার খবর মিলেছে। এমতাবস্থায় নবান্নের তরফে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। যে কোনও অসুবিধায় যোগাযোগ করা যাবে ওই নম্বরে। শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যের যে কোনও প্রান্ত থেকে দুর্যোগের কারণে সমস্যায় পড়লে যোগাযোগ করা যাবে নবান্নের কন্ট্রোল রুমে। নম্বরগুলি হল— (০৩৩) ২২১৪ ৩৫২৬, (০৩৩) ২২৫৩ ৫১৮৫। এ ছাড়াও টোল ফ্রি নম্বরও দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল— ৮৬৯৭৯৮১০৭০ ও ১০৭০।
বিরোধীদের তোপ
কলকাতার দুর্যোগ পরিস্থিতির জন্য বিজেপি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে পুরসভা এবং রাজ্য সরকারকে। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, আকাশভাঙা বৃষ্টি। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ভিন্রাজ্য দায়ী, বিহার থেকে জল ঢুকেছে। কিন্তু কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এটা তার প্রমাণ।’’ রাজ্য বিজেপির সভাপতির যুক্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতেই পারে। সেটা মানুষের হাতে নেই। কিন্তু সরকার বা পুর কর্তৃপক্ষের আগাম পরিকল্পনা তো থাকবে! তারা দায়িত্ব না-নিলে তো কপালের ভরসায় বসে থাকতে হবে নাগরিককে। তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রাক্তন কাউন্সিলর এবং বিজেপি নেতা তাপস রায় মেয়রের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করেছেন।
বুধের পূর্বাভাস
আগামী ২৪ ঘণ্টায় কলকাতায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। তবে বৃষ্টি যে একেবারে হবে না, তা-ও বলছে না হাওয়া অফিস। তারা জানাচ্ছে, বুধবার দিনভর কলকাতার আকাশ মূলত মেঘলা থাকবে। হালকা থেকে মাঝারি বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে কোথাও কোথাও। সেই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।