দিব্যেন্দু বিশ্বাস, নয়াদিল্লি: দুর্গাপুজো আসলে বার্তা দেয় মেলবন্ধনের। কোথাও সাবেকিয়ানার সঙ্গে মিশে যায় ইতিহাস। কোথাও আবার চিরাচরিত পুজোর সঙ্গেই যুক্ত হয় আধুনিকতা। কেদারনাথ মন্দির, চন্দননগরের আলো, দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের আদলে প্রবেশপথ, বাংলার নিজস্ব আলপনার ছোঁয়ায় এভাবেই পুজোয় চমক দিতে তৈরি দিল্লি, এনসিআরের কালীবাড়িগুলি। পুজোর ছন্দে গা ভাসিয়ে দেশের রাজধানী শহরের অধিকাংশ পুজোতেই এখন থিমের রমরমা। কিন্তু এর মধ্যেও কালীবাড়ির সাবেক পুজোগুলি ধরে রেখেছে আভিজাত্যের ঠাঁটবাট। পাত পেড়ে বসে ভোগ খাওয়াই হোক বা দশমীতে সিঁদুর খেলা—প্রবাসী বাঙালির কাছে এই সমস্ত কালীবাড়ির পুজো তাই শারদোৎসবের অন্যতম ‘ডেস্টিনেশন’।
১৯৪০ সাল। সরকারি প্রেস কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গেই এখানে চলে এসেছিলেন বহু বাঙালি কর্মচারী। প্রবাসে দুর্গাপুজো করতে শুরু হল প্রস্তুতি। মিন্টো রোড কালীবাড়ির পুজো শুরুর কাহিনিটা এমনই। পুজোর ৮৬তম বর্ষে এসেও সাবেকিয়ানার সঙ্গে আপস করেননি পুজো উদ্যোক্তারা। পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুখেন্দুশেখর বসাক জানালেন, এবছর অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে মিন্টো রোড কালীবাড়ির পুজোর প্রবেশপথ হচ্ছে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের আদলে। দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ির পুজোর এবার ৫৮ বর্ষ। ১৯৮২ সাল থেকে এই পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি—প্রণববাবুর জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এই পুজো। অন্তত এমনই দাবি পুজো আয়োজকদের। এবারের পুজোয় তাদের থিম ‘নারীশক্তির জাগরণ’। পুজোর সাধারণ সম্পাদক সুব্রত দাস জানান, পুজোর মণ্ডপ সাজানো হচ্ছে আলপনা দিয়ে। কমিটির মহিলা সদস্যরাই দিনরাত এক করে তা ফুটিয়ে তুলছেন তুলির টানে।
নিউদিল্লি দুর্গাপুজো সমিতির পুজো শুরু হয় ১৯৩৫ সাল নাগাদ। আরও কয়েক বছর পর তা পরিচিত হয় নিউদিল্লি কালীবাড়ির পুজো হিসেবে। সাবেকি এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ভোগপ্রসাদ। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে যে মেলা বসে, তার টানেও হাজির হন বহু মানুষ। তুলনায় কিছুটা নবীন হলেও দ্বারকা কালীবাড়ি নিজস্বতায় এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। পুজোর এবার ১৬ বছর। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে দ্বারকা কালীবাড়ির স্থায়ী মন্দিরটি। এখানে দুর্গাপুজো হয় মন্দির লাগোয়া চত্বরে। দ্বারকা কালীবাড়ির পুজোয় এবারের চমক ‘মানত প্যান্ডেল’। যে সুতো দিয়ে ‘মানত’ বা ‘মানসিক’ করেন ভক্তরা, মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেই সুতোগুলি। পুজোর সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষ বলেন, ‘প্রায় দেড় লক্ষ লাল সুতো ব্যবহার করে মণ্ডপসজ্জা চলছে। প্রায় চার হাজার বর্গমিটার জায়গায় এই মানত প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছে।’
সাবেকি পুজোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই দিল্লির মাতৃমন্দিরের পুজোয় তিনটি প্রবেশপথ তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন বিষ্ণুমন্দিরের আদলে। পুজোর এবার ৫৯তম বছর। দিল্লি থেকে কিছুটা দূরে এনসিআরের কালীবাড়ির পুজোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নয়ডা কালীবাড়ি নাম। ৪৩তম বর্ষে এই পুজোর এবারের আকর্ষণ কেদারনাথ মন্দির। পরিচালন সমিতির সহ-সভাপতি অনুপম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সকলে কেদারনাথ দর্শনের সুযোগ পান না। তাঁরা একবার নয়ডা কালীবাড়ির পুজোয় আসুন। সাবেকিয়ানায় মিশবে ভক্তি।’ গ্রেটার নয়ডা শারদীয়া সাংস্কৃতিক সমিতির পুজো আদতে পরিচিত গ্রেটার নয়ডা কালীবাড়ির পুজো হিসেবেই। সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. দেবর্ষি মুখোপাধ্যায় জানালেন, আমাদের এবার ২৫ বছরের পুজো। তাই উদ্দীপনা অনেক বেশি। চন্দননগরের আলোয় সাজবে আমাদের মণ্ডপ এবং সংলগ্ন এলাকা।’ দিল্লির সি আর পার্ক কালীবাড়ির পুজো অবশ্য কলকাতার একটুকরো ম্যাডক্স স্কোয়ার। সাবেকি পুজোর আমেজে ঝালমুড়ি খেতে খেতে এই কালীবাড়ির সুবিশাল প্রাঙ্গণে আড্ডা যেন বাঙালির প্রাণের আনন্দ।