শহরের জীবনযাত্রা উন্নত হলেও নিকাশি ব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে মান্ধাতার আমলে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খালগুলির জলধারণ ক্ষমতাও থেকে গিয়েছে সেই তিমিরে। সোমবার সারা রাতের বৃষ্টিতে কলকাতা বানভাসি হওয়ার পরে যা আরও এক বার প্রমাণিত হল। সেচ দফতর সূত্রের খবর, ২৪ ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের মতো জলধারণ ক্ষমতা রয়েছে কলকাতার খালগুলির। কিন্তু সোমবার সারা রাত শহরের কোনও কোনও এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল ৩৫০ মিলিমিটার।
খালের কারণে শহরের বিভিন্ন এলাকার জলবন্দি হওয়ার ঘটনা অবশ্য এ-ই প্রথম নয়। কিন্তু এ বার খালের দৈন্য দশার চিত্রটা প্রকট হয়েছে প্রায় সব ক’টি খাল উপচে যাওয়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, খালের গভীরতা বাড়ানোর দিকে কেন গুরুত্ব দেয়নি সেচ দফতর?
শহরবাসীর একাংশের বক্তব্য, এর পিছনে এক দিকে যদি থাকে সরকারের দূরদর্শিতার অভাব, অন্য পিঠে রয়েছে ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি খালপাড়ের সিংহভাগ জুড়ে থাকা দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারা। অভিযোগ, ওই দখলদারেরা শাসকদলের মদতেই সেচ দফতরের জায়গায় বসতি তৈরি করেছেন। কঠিন পদক্ষেপ করতে গেলে শাসকদলের তরফেই বাধা দেওয়া হয়েছে সেচ দফতরের আধিকারিকদের।
এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া শুধু বলেন, ‘‘বহু বার সতর্ক করা সত্ত্বেও মানুষ সচেতন হচ্ছেন না। প্লাস্টিক-সহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা খালে ফেলে খালের গভীরতা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। পুরসভা, পুর নিগম ও পঞ্চায়েতগুলিকে খালের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।’’
এর পাশাপাশি, খালপাড় থেকে পলি তোলার কাজে দীর্ঘসূত্রতা নিয়েও সরব হয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তাঁদের অভিযোগ, খাল কাটার পরে পাড়ে পলির স্তূপ ফেলে রাখা হয়। বৃষ্টিতে সেই পলি ধুয়ে ফের খালের জলেই মেশে। সেচ দফতর এই সমস্যার কথা মেনে নিলেও জানিয়েছে, সম্প্রতি একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেখানে পলি সংস্কারের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে অর্থের বিনিময়ে সেচ দফতরের কাছ থেকে সেই পলি সংগ্রহ করতে হবে। যদিও কলকাতার খাল থেকে তোলা পলিতে পাঁকের পরিমাণ বেশি থাকায় তা তুলতে চায় না ঠিকাদার সংস্থা, এমনও খবর।
মঙ্গলবার কলকাতা বানভাসি হওয়ার পরে খালের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে সেচ দফতর ও কলকাতা পুরসভার মধ্যে। জানা গিয়েছে, ই এম বাইপাস লাগোয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টালিগঞ্জ-পঞ্চান্নগ্রাম খাল উপচে ভেসেছে যাদবপুর, সন্তোষপুর, সার্ভে পার্ক, বালিগঞ্জ, যোধপুর পার্ক। টালি নালা উপচে যাওয়ায় কালীঘাট, চেতলা-সহ একাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। সুতি খাল, গুনুয়াগাছি, বিবি পশ্চিম-১, পর্ণশ্রীর মতো খালগুলি জলে ভরে যাওয়ায় দক্ষিণ শহরতলির বহু এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। বিবি-১, সুলংগুড়ি, কেষ্টপুর কিংবা বাগজোলা খালের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি হওয়ায় জলবন্দি হয়েছে সল্টলেক, পাঁচ নম্বর সেক্টর এবং নিউ টাউন।
সেচ দফতরের আধিকারিকেরা জানান, আবহাওয়া দফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ২৫০ মিলিমিটার। তাতেই বন্যার কবলে পড়ে কলকাতা। এ বার শুধু দক্ষিণ শহরতলির কামডহরি এলাকাতেই ৩৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা নিকাশির সমস্ত হিসাব এলোমেলো করে দিয়েছে বলে দাবি তাঁদের। তাঁরা জানান, গঙ্গায় জোয়ার নামার সঙ্গে সঙ্গে খালগুলি থেকে জল ছাড়া যাবে। তাতে আজ, বুধবার সকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।