• সে বারও শরৎকাল, বৃষ্টির মধ্যে যেন ভয়ঙ্কর আক্রোশ
    আনন্দবাজার | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • শীর্যেন্দু মুখোপাধ্যায়

    সোমবার গভীর রাতে যে ভয়ানক রাগী বৃষ্টির অজস্র বল্লম কলকাতাকে প্রায় ছিন্নভিন্ন আর নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে, তাতে প্রমাদ গুনেছেন মানুষ। এ শহর এখন প্রায় ভেনিসের মতোই ভাসমান। কেউ কেউ বলছেন, এ যেন সেই আটাত্তরের বন্যার রিপিট টেলিকাস্ট। হ্যাঁ, খানিকটা ওই আটাত্তরের মতোই বটে। তবে, ইনি হলেন ছোট বোন। বড় জন ছিলেন আরও অনেকটা তিরিক্ষি মেজাজের এবং আরও বেশি খেপি। তিনি প্রলয়নৃত্য করেছিলেন ভরদুপুর থেকে শুরু করে সন্ধে পর্যন্ত।

    আমি তখন আনন্দবাজার পত্রিকার দফতরে বসে কাজ করছি। দফতরের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত অভ্যন্তরে বসে বাইরের আবহাওয়া টের পাওয়া যায় না। বৃষ্টি হচ্ছে বলে খবর ছিল। তবে, সেটা কোন মাত্রার, তা নিয়ে তেমন উদ্বেগ ছিল না। সে বারও ছিল শরৎকাল। তাই ভয়ের তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে দেখছিলাম, বৃষ্টিটা স্বাভাবিক নয়। তার ধরন-ধারণে একটা ভয়ঙ্কর আক্রোশ আছে যেন। যেন একটা শোধবোধ, বোঝাপড়া বা হেস্তনেস্ত করে নিতে চাইছে। দাঁত-নখ বার করা তার চেহারা। এমনই তার সঘন ধারাপাত যে, রাস্তার উল্টো দিকের বাড়িগুলোও বৃষ্টির পর্দায় ঢেকে গিয়েছে। একটু উদ্বেগ হয়েছিল তখন।

    অল্পেই যাদের উদ্বেগ হয়, আমি তাদেরই এক জন। এমন ভয়ঙ্কর বৃষ্টি আমি উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, শিলিগুড়ি বা অসমেবহু বার দেখেছি। বানভাসিও হয়েছি অনেক বার। তবু একটু ভয় করছিল, বাড়ি ফেরা নিয়ে। তখন থাকি যাদবপুরের নর্থ রোডে। বাড়িতে আমার স্ত্রী তখন মেয়ে এবং সদ্যোজাত ছেলেকে নিয়ে প্রায় একা। মোবাইল আবিষ্কৃত হয়নি। আর ল্যান্ডফোন তখন অ্যান্টিম্যাটারের মতোই দুষ্প্রাপ্য।

    সহকর্মী সুনীল (গঙ্গোপাধ্যায়) আমাকে বললেন, ‘‘চিন্তা করবেন না। আমার গাড়িটা ছোট হলেও জলটল ঢোকে না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।’’ ওই পরিস্থিতিতে সুনীলের কথায় খুব যে একটা ভরসা হয়েছিল, তা নয়। সুনীল তো বরাবরই একটু ডাকাবুকো। ওঁর মোটো-ই ছিল, ‘যা-ই হোক, দেখা যাবে।’

    তো সন্ধের মুখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুনীলের গাড়িতে। সুনীল, তরুণ লেখক রাধানাথ মণ্ডল, চালক মোহিন্দর আর আমি। চার দিকে জল আর জল। গাড়ির চাকা তখনও অর্ধেকটা জলের তলায়। এসপ্লানেড অঞ্চল বলে তখনও বাকি শহর কতটা ডুবেছে, তা টের পাওয়া যাচ্ছিল না। বৃষ্টি তখনও হয়েই চলেছে। তবে, তার রাগ যেন কমেছে একটু।

    সুনীলের আবার নিউ মার্কেট থেকে মাংস কেনার ছিল। সেখানে গেল প্রায় আধ ঘণ্টা সময়। তার পরে গল্প করতে করতে দিব্যি যাচ্ছি। গাড়ি পার্ক স্ট্রিট হয়ে এগোতে লাগল। কিন্তু গাড়ি যত এগোয়, ততই আমাদের মুখ শুকোয়। জল বাড়ছে। সুনীলকেও এ বার একটু অস্বস্তিতে পড়তে হল। বললেন, ‘‘তাই তো শীর্ষেন্দু, এ তো ভীষণ জল!’’

    আমাদের চেনা পথ ধরেই রিচি রোডের মুখে এসে গাড়ি প্রায় ডুবজলে পড়ে থেমে গেল। গাড়ির ভিতরেও জল ঢুকছে তখন। আমরা নেমে পড়লাম কোমর সমান জলে। গাড়িটাকে সবাই মিলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম টিভোলি কোর্টের পাশের এক গ্যারাজে। তারা অবশ্য প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু আমরা তখন নাচার। গাড়ি তো আর পথের মাঝখানে ফেলে যাওয়া যায় না!

    ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমরা হাঁটাপথে রওনা দিলাম। যত এগোই, তত আমাদের কোমর ছাড়িয়ে জলের স্তর উপরে উঠতে থাকে। গুরুসদয় দত্ত রোড ছাড়িয়ে গড়িয়াহাট রোডে ঢুকতেই আমাদের বুক সমান জল হয়ে গেল। মোহিন্দর ছোটখাটো মানুষ বলে তার গলা-জল। অগত্যা আমরা ট্রামলাইনে উঠে পড়লাম। ট্রামলাইনের বেড একটু উঁচুতে বলে খানিকটা রক্ষা। রাস্তায় কোনও গাড়িই নেই। কিছুই চলছে না। শুধু জল ভেঙে শয়ে-শয়ে মানুষ উত্তর বাদক্ষিণমুখো যাচ্ছেন।

    খুব যে খারাপ লাগছিল, তা নয়। বরং একটা নতুন মজাদার কিছু হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছিল তখন। জল ভাঙতে ভাঙতে গল্পগুজব করছি, হাসাহাসি করছি। জল ভাঙার পরিশ্রম লঘু হয়ে যাচ্ছে। রোজকার মতো একঘেয়ে বাড়ি ফেরা তো এ নয়! গড়িয়াহাটে সুনীলের বাড়ি, আমি আর রাধানাথ যাব আরও দূরে। আমি যাদবপুর, রাধানাথ বৈষ্ণবঘাটা। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সুনীল। বললেন, ‘‘না শীর্ষেন্দু, গোলপার্কের কাছে জল আরও বেশি। আপনারা আজ আমার ফ্ল্যাটেইথেকে যান।’’

    অগত্যা তা-ই হল।

    পরে জেনেছিলাম, ঢাকুরিয়া উড়ালপুলের মুখে সত্যিই ডুবজল হয়ে গিয়েছিল সে দিন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)