পার্থ চৌধুরী: গোটা বাংলা এখন সেলিব্রেশন মুডে। সারা বছরের প্রতীক্ষার পরে আনন্দময়ী মা আসছেন। আর ঠিক এই সময়ে রাঢজননী সর্বমঙ্গলা মন্দিরের এককোণে বসে ভিক্ষা করছেন ভগবতী। ভগবতীদেবী এক অশীতিপর মা। অসুস্থ, অকেজো একমাত্র ছেলের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে এই ক্লেশ।
একবছর আগেও বাসন মাজতেন। খেটে খেতে আর পারছেন না। তাই এই ভিক্ষাবৃত্তি। তবু রোজ নিজেরও আর ভাত জোটে না। কারণ ভিখিরি সমাজে তিনি নতুন। তাই তার নিয়মকানুন জানেন না। তাই মন্দিরের এককোণে তিনি বসে থাকছেন প্রতিদিন। এই উৎসবমুখর সময়ে যদি কারো মন গলে তার দুঃখ শুনে। এই ব্যস্ত সময়ে এই জেট যুগে কেই বা কার দুঃখ গোনে।
এদিকে গতকালই মহাসমারোহে সর্বমঙ্গলা মন্দিরে শুরু হয়ে শারদোৎসব। চলবে নবমী অবধি। প্রতিপদে মাকে রাজবেশ পরানো হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ি করে ঘটোত্তলন করা হয়েছে। ছিলেন জেলাশাসক, বিধায়ক,মহকুমাশাসক থেকে প্রশাসনের বড়কর্তারা। গোটা বর্ধমানের মত এই মন্দিরেও বিধায়কের অসীম প্রভাব। তবু সবার নজর এড়িয়ে গেছে এই ধাক্কা দেবার মত ঘটনাটা।
আমরা বাঙালি। মাতৃপুজা করি। তাই আসুন শুনে নিই, এক মায়ের মর্মবেদনা। এই ভরা উৎসবের অন্তরালে দারুন মর্মব্যথা। জেনে নিই এই ভগবতীর কথা।
ভগবতী গড়াই। আদি বাড়ি শোলাশিল্পের জন্য বিখ্যাত বনকাপাসির কাছে যজ্ঞেশ্বরডিহি গ্রামে। ভিক্ষে করে খাবার মত পরিবার তার নয়। স্বামী মৃত্যুঞ্জয় গড়াই ছিলেন ছোট চাষী। কিছু জমি জায়গা ছিল। অলস মানুষ ছিলেন। তাই সব কিছু একসময় বিক্রি হয়ে যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে অকুল পাথারে তখন ভগবতী। আটাত্তরের বন্যায় ভাসতে ভাসতে বর্ধমান শহরে আশ্রয় নেন তিনি। একসময় বাড়িভাড়া বাকি পড়ে। ঠাঁইহারা হন। এর মধ্যে বড় ছেলে টিউমার হয়ে ভুগে মারা যান। ভাল চিকিৎসা হয়নি অভাবে।
কাঞ্চননগরে তার স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে থাকে। ছোট ছেলেকে নিয়ে ভগবতী থাকেন একজনের দয়ায় বাড়ির উপান্তে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভাতছালা পাড়ায়। তারাও দিন আনে, দিন খায়। ছোট ছেলে বোহেমিয়ান। নাম রমেশ গড়াই।
এখন আরব কিছু কাজ করার ক্ষমতা নেই। এখন অসুস্থ। বয়স ৩৫ বছর। দুর্ভাগ্য একা আসে না। এর মধ্যে ভয়ংকর জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন সেই ছোট ছেলে। কিছুদিন আগে, টানা ১৮ দিন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। অভাবে চিকিৎসা তেমন করাতে পারেন নি অসহায় মা।এখন তাকেই বাঁচাতে চান। কাউকে কাউকে দু:খের কথা বলেন ভগবতী। শোনে না কেউ। মন্দিরে আসা ভক্তরাই তার কাহিনী শুনেছেন।
ভগবতীর দুঃখ তো অসীম।
গ্রামের পোড়ো বাড়ি একসময় মাটিতে মিশে যায়। বর্ধমানে ৭৮ এর বন্যার সময় চলে আসা ভগবতী লোকের বাড়ির এককোণে ঠাঁই পান। বাসন মেজে খেতেন। বয়স হয়েছে। তাই আর কাজ পান না। এখন তাই ভিক্ষে করে খান। ছেলে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে।নিজের ভাত জুটুক বা না জুটুক ছেলের ভাত ফোটান অশক্ত মা। ফোটানোর আগে জোটানোর পালা।
এদিকে, মন্দিরের রয়েছে প্রায় শতাধিক পুরনো ভিখিরি। তাদের নিয়মকানুন এই মা জানেন না। ভাগ পান না গড় ভিক্ষার। তাকে তারা পছন্দ করেও না। সেজন্যই এককোণে বসে ভগবতী। ভেক না ধরলে ভিক্ষে মেলে না। ভগবতী ভিক্ষের ঝুলি নেই,বাটিও নেই।
সম্বল রুগ্ন,অশক্ত হাত। তাই বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য চাইছেন তিনি।
অসুস্থ সন্তানের মুখে ভাত জোগাতে ভিক্ষা করছেন অশীতিপর মা। ' এই দৃশ্য ধাক্কা দিয়েছে রাজনৈতিক মহলেও।
সিপিআই এমের জেলা কমিটির সদস্য দীপঙ্কর দে বলেন, ' যে মন্দিরে এত ভিআইপি আসছেন তাদের নজর এড়িয়ে গেল কীভাবে? এক ফোনে এমএলএ, পাড়ায় সমাধান, আমিই পারি এইসব হোর্ডিং দিলেই মানুষের দুঃখ ঘোচে না। আমরা চাই, উৎসবের এই মরশুমে কোনো মাকে যাতে সন্তানের জন্য ভিক্ষা না চাইতে হয়। অন্যদিকে প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য নেতা দেবু টুডু জানিয়েছেন, ' সন্তানের জন্য এক মা ভিক্ষা করেছন, এটা দুঃখের। তিনি এ ব্যাপারটা নজরে আনবেন।
বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র জানান, এই ঘটনা ধাক্কা দেবার মত। রাজ্যে মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর এত প্রকল্পের প্রচার। তার মাঝে এই একজন মা সন্তানকে বাঁচাতে ভিক্ষে চাইছেন। বিধায়ক তো এত কাজের প্রচার করেন। তিনি দেখেন নি কেন? তিনি আরো জানান, বিজেপির তরফে ওই বৃদ্ধাকে কিছু সাহায্য করা যায় কী না তা তিনি দেখবেন।
অন্যদিকে এই নিয়ে সরব শহরের নাগরিকরাও। গতকাল মন্দিরে আসা মানুষদের মত আজ স্বেচ্ছাসেবী প্রীতম তা জানান, এ নিয়ে সমাজের সচেতন হওয়া উচিত।
তবে সকলেই জি ২৪ ঘন্টাকে এই ঘটনা তুলে আনার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।