মা আসছেন, হুগলির গুপ্তিপাড়া থেকে সুদূর জার্মানির এসেন সর্বত্র প্রস্তুতি তুঙ্গে
দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শোভনলাল চক্রবর্তী
যেকোনো বিচক্ষণ বাঙালিকে দুর্গাপূজা সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে বলুন, তারা আনন্দের সঙ্গে হাতের কাজ ছেড়ে দিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। সকলেই এটা মুখস্থ জানেন— প্রতি বছর, মা দুর্গা স্বর্গীয় কৈলাস থেকে পৃথিবীতে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর পার্থিব ভ্রমণে তাঁর চার সন্তান— সোনালি বর্ণের লক্ষ্মী, প্রতিটি ভারতীয় শিল্পীর মনীষী সরস্বতী, হাতির মাথাওয়ালা গণেশ এবং যুদ্ধের দেবতা কার্তিক— তাঁর সঙ্গে থাকেন। মা দুর্গা হলেন সমস্ত পৃথিবীবাসীর মা, যিনি নিজের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের শক্তি একত্রিত করেন। তিনি প্রতি বছর তাঁর ভক্তদের কাছে আসেন এবং তাদের ইচ্ছা পূরণ করেন, তাদের পাপ ক্ষমা করেন, তাদের কষ্ট মুছে দেন এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনেন। অনাদিকাল থেকে এই রীতি চলে আসছে এবং যুগ যুগ ধরে চলবে। দুর্গাপূজার উৎপত্তি ১৮ শতকের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের হুগলির গুপ্তিপাড়ার বারো বন্ধুর দ্বারা আয়োজিত প্রথম বারো-ইয়ারি পূজা থেকে। তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলায় প্রথম সম্প্রদায় পূজা পরিচালনা করে। বারো-ইয়ারি পূজা দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা এখন থিম পূজায় পরিণত হয়েছে, প্রতিটি পূজা মণ্ডপে প্যান্ডেলের সাজসজ্জায় একটি নির্দিষ্ট থিম চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে অসাধারণভাবে কারুকাজ করা প্যান্ডেল এবং অলঙ্করণ তৈরি হয়েছে, যা শিল্পের অগ্রণী কাজ। তবে, এই উৎসবের প্রতি বাঙালিদের অগাধ ব্যস্ততাই সমস্ত যুক্তিকে অস্বীকার করে। দশমীতে, দেবী বিসর্জনের জন্য যাওয়ার সময় শোকাহত পূজারীরা তাঁদের চোখ থেকে জল মুছে ফেলেন। কেউ কেউ এমনকি দাবি করেন যে, তারা দেবীকে কয়েকবার নীরবে কাঁদতে দেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে, কুমারটুলির ভাস্কররা ৫ দিন পরে গলে যাওয়া কাদামাটিতে এক ধরনের তেল ঢেলে তাকে এক বিষণ্ণ চেহারা দেয়। বেশিরভাগ মানুষ এই ‘নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত রহস্য’ সম্পর্কে জানেন, তবুও সকলেই এই পৌরাণিক কাহিনী বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন। সর্বোপরি, এটি বাংলা, যেখানে দুর্গাপূজা বিশ্বাস, উৎসব এবং উন্মাদনার সমার্থক, এমনকি আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসেরও সমার্থক এবং বিপজ্জনকভাবে আবেগের সীমানায় সীমাবদ্ধ।
একইভাবে, পুজোর সময় সরকারি অফিস, পৌরসভা, ব্যাঙ্ক, ডাক্তারদের চেম্বার এবং আইন আদালতের সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে খুব একটা যুক্তি নেই। সম্ভবত বছরের এই ৫টি দিনই ক্রিকেট খেলা পিছিয়ে পড়ে এবং পূজা উদযাপন সর্বত্র শিরোনামে স্থান পায়। এই ধরনের বিচ্যুতির পিছনে কোনও ছন্দ বা যুক্তি নেই, সমগ্র বাংলা কেবল এই অসাধ্য অদ্ভুততায় ডুবে থাকতে পছন্দ করে। দুর্গাপুজো তো সবার, কলকাতার বাঙালি, পচিমবঙ্গের বাঙালি, ভারতবর্ষের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর সব কোণায় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির মনে দুর্গা পুজো মানে এক অনন্য উৎসব। আর এবার সেই খুশির উদ্যাপনের রঙে রঙ মেলাতে তৈরি আরও একটি প্রবাসের পুজো, জার্মানির এসেন শহরের একমাত্র বাঙালী কমিউনিটি ইন্ডিয়ান কালচারাল কানেক্ট এসেন ইভি। দ্বিতীয় বছরের জন্য এই দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছেন তাঁরা। ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর তিথী নক্ষত্র খেয়াল রেখেই মাতৃ আরাধনায় মেতে ওঠার শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত এই কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত সদস্যরা। গত বছর পুজো হয়েছিল, তবে কুমোরটুলি থেকে মন্টু পালের করা ডাকের সাজের পাঁচচালা মূর্তি আটকে যায় রোটারডাম বন্দরে। তাই গতবছর সেই মূর্তিতে পুজো হয়নি। এবার হচ্ছে, শুধু হচ্ছে নয়, হচ্ছে দ্বিগুণ উৎসাহে। দ্বিতীয় বছরের পুজোতে এসেনের থিম ‘নিভৃত্তি’। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষ না, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যে অযাচিত অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা, তার বিপরীতে গিয়ে মা দুর্গার কাছে আলোর উপাসনা করা, বিশেষ করে বলতে গেলে চেতনার আলোর উপাসনা করা, এই তাঁদের লক্ষ্য। এসেনের পুজোর একটা বিশেষত্ব আছে, সেটা খুব গর্ব করে বলার মত ব্যাপার সেটা হল এই যে, সমস্ত কাজের ফাঁকে সদস্যরা নিজেরাই থিম নির্বাচন করে এবং মণ্ডপ সাজিয়ে তোলেন। যত রান্নাবান্না সব নিজেরা করেন। গান, নাটক, কবিতা ফ্যাশন শো সব কিছু করেন নিজেরা। বিগত বছরে এসেনের পুজোর সময়ও একইভাবে, সমস্ত সদস্যরা মিলে সাজিয়ে তুলেছিলেন মণ্ডপ, দেশ থেকে দূরে থেকে এটা যে কি আত্মিক অনুভূতি! এই বছরেও ব্যতিক্রম হবে না। এই বছর মা দুর্গার কাছে অন্ধকার অপসারণের প্রার্থনায় মাতবেন এসেন শহরের একমাত্র দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তরা। দুর্গা পুজো আয়োজনের পাশাপাশি সরস্বতী পুজো, পয়লা বৈশাখ-এর মতো উৎসব ও সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ইন্ডিয়ান কালচারাল কানেক্ট-এর সদস্যরা। এঁদের পুজোর একটা বড় অংশ কাটে শিশুদের দিয়ে অনুষ্ঠান করানোয়। নাচ, গান, নাটক সব করে শিশুরা। বিদেশে বসবাসকারী শিশুদের দেশের বিশেষ করে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধনের এই বড় কাজটি এনারা করে চলেছেন, এর জন্য এনাদের নিশ্চয় বড় করে ধন্যবাদ প্রাপ্য। উৎসব তো তখনই, যখন মানবিকতায় তার ভিত্তি প্রস্তর নির্মিত হয়। এভাবেই প্রতি বছর দুর্গোৎসব আয়োজন করতে চান এসেনবাসীরা। যাঁরা এই উৎসবের আলোর নিচের আঁধারে, তাঁদের আলোর দিশা না দেখালে মাতৃ আরাধনা বোধহয় সম্পূর্ণ হয় না। আসন্ন পুজোর থিম বৃহতর্থে সে কথাই জানাচ্ছে সমস্ত পৃথিবীকে। বিদেশে যাঁরা থাকেন দুর্গাপূজার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয় দেবীর এক ঝলক দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে। আসন্ন ঠান্ডার মধ্যেও তাঁরা প্রিয় লাল শাড়ি পরে, সপ্তাহান্তে ব্যস্ত হয়ে পূজায় বসে থাকি এবং নাক দিয়ে স্বাদের খাবার খাই। কিন্তু হৃদয় জানে যে এই সবই আমার জন্মভূমিতে উদযাপনের আনন্দ এবং উৎসাহের থেকে অনেক দূরে। অনেকের সঙ্গে প্রেমের আদান-প্রদান হয় এবং একে অপরের মুখে এক মুঠো সন্দেশ ঢেলে দেওয়া হয়। রান্নার হাঁড়ির সুস্বাদু সুবাসের মতো বাতাসে উৎসবের মেঘ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ প্যান্ডেলগুলিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, একে অপরের সঙ্গে মেরুদণ্ড ঘষে, বছরের বাকি ৩৬০ দিন তাদের মধ্যে যে সামাজিক শৃঙ্খলা রয়েছে তা তারা বোঝে না। সম্ভবত এখানেই নিহিত আছে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে সম্মানিত উৎসবের ভ্রমণের শক্তি।