• অস্ত্র সমর্পণ বিতর্কের মাঝেই রহস্যজনক ‘এনকাউন্টার’...
    আজকাল | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: অস্ত্র সমর্পণ প্রসঙ্গ নিয়ে মাওবাদী শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মতপার্থক্যের প্রকাশ্য রূপ পাওয়ার পরপরই ছত্তিশগড়ের আবুজমাড় জঙ্গলে নিহত হলেন সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির দুই প্রবীণ নেতা। ঘটনাটি ঘিরে উঠছে একাধিক প্রশ্ন, বিশেষত তাঁদের মৃত্যু ‘সত্যিকারের সংঘর্ষে’ না ‘গোপন অভিযানে’ হয়েছে তা নিয়ে।

    পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহতরা হলেন কট্টা রামচন্দ্র রেড্ডি ওরফে বিকল্প ওরফে রাজু দাদা (৬৩) এবং কাদারি সত্যনারায়ণ রেড্ডি ওরফে কোসা (৬৭)। তাঁরা উভয়েই তেলেঙ্গানার করিমনগর জেলার কোহেদা ও সিরসিল্লা মণ্ডলের বাসিন্দা। ছত্তিশগড় সরকার তাঁদের মাথার ওপর ৪০ লক্ষ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। দু’জনই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির (ডিকেএসজেডসি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

    সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র মল্লোজুলা ভেনুগোপাল রাও ওরফে অভয়-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি তীব্র আলোচনার জন্ম দেয়। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, মাওবাদীরা “শান্তি আলোচনার স্বার্থে সাময়িকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম স্থগিত” রাখতে রাজি। তেলেঙ্গানা রাজ্য কমিটি তৎক্ষণাৎ তার বিরোধিতা করে জানায়, রাও-এর মতামত কেবল তাঁর ব্যক্তিগত।

    ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে সত্যনারায়ণ রেড্ডি নিজেকে কেন্দ্রীয় কমিটির নতুন মুখপাত্র ‘অভয়’ হিসেবে পরিচয় দেন, আর রামচন্দ্র রেড্ডি দায়িত্ব নেন ডিকেএসজেডসি মুখপাত্র হিসেবে। ওই বিবৃতিতে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন— সিপিআই (মাওবাদী) সশস্ত্র সংগ্রামের পথ থেকে সরে আসছে না, বরং রাও-এর মতামতকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে অভিহিত করেন।

    তাঁরা অভিযোগ করেন, ভেনুগোপাল রাও দলের ঐক্য নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক নম্বালা কেশব রাও (বাসবরাজু) অস্ত্র ত্যাগের পক্ষে ছিলেন। তাঁদের মতে, রাও চাইলে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, কিন্তু দলীয় অস্ত্র আত্মসমর্পণ করতে হবে পার্টির কাছেই, নইলে ‘জনগণের মুক্তি গেরিলা বাহিনী’ অস্ত্র নিজের দখলে নেবে। ২২ সেপ্টেম্বর সকালে ছত্তিশগড়-মহারাষ্ট্র সীমান্তবর্তী আবুজমাড় জঙ্গলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের খবর প্রকাশ করে বস্তার রেঞ্জের আইজি সুন্দর রাজ পি। তাঁর দাবি, “সকাল থেকে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলার পর দু’জন পুরুষ মাওবাদীর দেহ উদ্ধার হয়, সঙ্গে মেলে বিস্ফোরক ও অস্ত্র।”

    কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ও গণতান্ত্রিক মহলের দাবি, ঘটনাটি সাজানো ‘ফেক এনকাউন্টার’। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের তিনস্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকে। সেই রক্ষী বাহিনীর কাউকে হারানো বা গ্রেপ্তারের খবর নেই। তাছাড়া, দুই শীর্ষ নেতার একই জায়গায় উপস্থিত থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্ভবত অভ্যন্তরীণ সংকট ও চলাফেরার পরিবর্তনের কারণে তাঁদের অবস্থান ফাঁস হয়ে যায়। তেলেঙ্গানা সিভিল লিবার্টিজ কমিটি ইতিমধ্যেই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

    ১৯৯৯ সালে করিমনগরের মান্থানির কোয়্যুরে নল্লা আদি রেড্ডি ও এয়ারামশেট্টি সান্তোষ রেড্ডি নিহত হওয়ার পর এবারই প্রথম এক অভিযানে কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য নিহত হলেন। গত মাসেই মোট চারজন কেন্দ্রীয় সদস্য নিহত হয়েছেন এবং একজন আত্মসমর্পণ করেছেন। এতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসংখ্যা নেমে দাঁড়াল মাত্র আটজনে। কট্টা রামচন্দ্র রেড্ডি পেশায় ছিলেন এক সরকারি শিক্ষক। প্রায় ৩৬ বছর আগে তিনি পিপলস ওয়ার গ্রুপে যোগ দেন।

    কাদারি সত্যনারায়ণ রেড্ডি ছিলেন কেসোরাম সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক। গেরিলা কৌশলে তিনি দক্ষ ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে দণ্ডকারণ্যে সক্রিয় ছিলেন। অস্ত্র সমর্পণ নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে বিভাজন, মুখপাত্র পদে পরিবর্তন এবং পরপর কয়েকজন কেন্দ্রীয় সদস্যের মৃত্যু— সব মিলিয়ে সিপিআই (মাওবাদী) বর্তমানে গভীর সংকটে। এই পরিস্থিতি কেবল মাওবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নয়, সরকারের ‘অপারেশন খগর’-এর কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
  • Link to this news (আজকাল)