রমেন দাস: অন্ধ কানাই পথের ‘পরে, গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে! ‘সহজ পাঠে’র অন্ধ কানাই তিনি নন, ভিক্ষাও করেন না। কিন্ত গান শোনান। শুনিয়ে ছোট্ট আবদার, ”কিছু দরকার হলে নিয়ে যাবেন।” পুজোপার্বণে, উৎসবের ঝংকারের মাঝেই পেটের দায়ে তাঁর লড়াই চলে রোজকার মতো। রেলগাড়ির কু ঝিক ঝিক শব্দের হিল্লোলের সমান্তরালে ভেসে থাকে তাঁর গান! ব্যস্ত, চূড়ান্ত ব্যস্ত পথচারীদের পথ চলার প্রেক্ষাপট হয়ে তিনি যেন গেয়ে চলেন জীবনের জয়গান!
দমদম রেল স্টেশন। শিয়ালদহের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে যে সাবওয়ে, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন মহিলা। উচ্চতায় ছোটখাটো, গায়ের রং শ্যামলা। পথচারীদের গান শুনিয়ে তিনি বলে চলেন, “ও ভাই, ও মা, একটা রুমাল নাও না! একটা পেন নেবে গো!” কেউ সাড়া দেন, কেউ ঘুরেও তাকান না! কিন্তু এই শব্দ যেন বলে চলে, খেলে আমি খেটেই খাব, ভিক্ষা করব না।
স্বপ্না দাস। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের কাছে থাকেন তিনি। বাড়িতে দুই সন্তান! স্বপ্না চোখে দেখেন না। দৃষ্টিহীন হিসেবেই দিন কাটে। স্বামীও বিশেষভাবে সক্ষম। স্বপ্না প্রত্যেক দিন ঘরের কাজ সামলে হাতে একটি সাদা রঙের ব্যাগ, কাঁধে আর একটি ব্যাগে বয়ে আনেন বাঁচার লড়াইকে!
কিন্তু কখনও ভিড় ট্রেন, কখনও নানা প্রতিবন্ধকতায় গতিহীন হলেও থামেননি স্বপ্না। বছরের পর বছর ধরে দৃষ্টিহীনতাকে হেলায় হারিয়ে গান শোনান। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে মানুষদের শেখান কীভাবে বাঁচতে হয়!
স্টেশন চত্বরের এই হকারের আর উৎসব পালন করা হয় না! বরং বেশি ভিড়, কম বিক্রির চাপা টেনশন গ্রাস করে ওঁকে। তবুও কেমন কাটে পুজো? সাবওয়েতে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বীকারোক্তি, “খুব একটা ভালো না, পুজোর সময় বৃষ্টি হলে সমস্যা বাড়ে। রোজ আসি স্টেশনে। বিক্রি হয় কিছু। আবার কখনও বেশ কম। বিক্রির পর ফিরে যাই বাড়িতে। মোটামুটি যা হয় তাই দিয়েই তো সংসার চলে।”
স্বপ্নার কথায়, ‘আগের পুজোয় খুব কষ্ট হয়েছিল। জানো তো, আমি ১০ হাজার টাকার মাল তুলেছিলাম। ব্যাগ রেখে যেই সরেছি, আমার ব্যাগটাই চুরি হয়ে গেল! চোখে দেখি না, সুযোগ নিল কেউ। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বাঁচতে তো হবে বলো।” কেমন যেন উৎসবের আবহে, উত্তেজনা-বিতর্ককে পেরিয়েও প্রশ্নের ছলে এগিয়ে যাওয়ার পাঠ দেন তিনি।
আপনার পাশেই তো বহু মানুষ ভিক্ষা চাইছেন? সেই পথে গেলেন না কেন? স্বপ্নার উত্তর, “কেন ভিক্ষা করব? আমি দৃষ্টিহীন, আমার স্বামীও প্রতিবন্ধী। কিন্তু কিছু করে যদি আয় হয়, তাহলে কেন বিনামূল্যে লোকের কাছে চাইব? কাজ করব না কেন?” মায়ের কাছে কী চাইবেন? ঠাকুর দেখেন কীভাবে? দমদম স্টেশনের মহিলা হকার বলছেন, “মা তো সুযোগই দিলেন না! দেখব কীভাবে? ওই যেটুকু বুঝি, চেষ্টা করি কেমন হয় ঠাকুর, সেটা বোঝার। ঠাকুর দেখতে যেতেই পারি না। ভিড়ের মধ্যে কোথায় পড়ে যাব!” মায়ের কাছে কী চাইবেন? তাঁর জবাব, “কিছুই না, ভালো রেখো মা, লড়াই করার শক্তি দিও শুধু।”
একের পর এক ট্রেন আসে। সাবওয়েতে গমগম করে ভিড়। ভাঙা গলায় চিৎকার করে আবার তিনি গেয়ে ওঠেন, অনুরোধের সুরেই বলে যান, “তোমারই চলার পথে, দিয়ে যেতে চাই আমি, একটু আমার ভালোবাসা।”