নিজস্ব প্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর: দুর্গাপুজোর সময়ে রঙিন হয়ে ওঠে নদীয়ার শহর ও গ্রাম। প্যান্ডেল ভরে ওঠে আলোয়, ঢাকের তালে তালে বইতে থাকে আনন্দের ঢেউ। রাতভর ঠাকুর দেখা, আড্ডা, হাসিতে মেতে ওঠে মানুষ। কিন্তু এই আনন্দের জোয়ার থেকে অনেকটাই দূরে থেকে যায় সীমান্তঘেঁষা কিছু গ্রাম। দুর্গোৎসবের আলোকচ্ছটাদূর থেকে দেখেই মনকে শান্ত রাখেন গ্রামবাসীরা।
ভারতীয় হয়েও এইসব গ্রামের বাসিন্দারাথাকেন সীমান্তের ওপারে। দেশের মানচিত্রে তাঁরা ভারতীয় হলেও বাস্তবে জীবনযাপন করতে হয় কড়া নিয়মের ঘেরাটোপে। তাঁদের প্রতিদিনের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় সীমান্তের গেটের সময়সূচি মেনে। সকাল পাঁচটায় গেট খোলে, তখন গ্রামের মানুষজন পরিচয়পত্র দেখিয়ে এপারে আসতে পারেন। বাজার করা, চিকিৎসা, কাজকর্ম বা অন্যান্য দরকারি কাজে। কিন্তু সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত আটটার মধ্যে যেভাবেই হোক সবাইকে গ্রামে ফিরে যেতে হয়। আটটার পর গেট বন্ধ হয়ে গেলে, তাঁরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
দুর্গাপুজোর সময়ে এই নিয়ম তাঁদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। যখন শহরের মানুষ রাতভর পুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন, তখন সীমান্তের ওপারের গ্রামের মানুষ দূর থেকে কেবল সেই আলো দেখেন। মণ্ডপে গিয়ে প্রতিমা দর্শন, ভিড়ের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া,এসবই তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ।
চাপড়া ব্লকের হাটখোলা গ্রামে প্রায় কয়েকশো পরিবারের বসবাস।তাঁদের প্রতিদিন বাজারঘাট বা অন্য প্রয়োজনের জন্য আসতে হয় চাপড়া বাসস্ট্যান্ডে।কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের কুলোপাড়া গ্রাম, গোবিন্দপুর পঞ্চায়েতের দিগম্বরপুর এলাকা, মহেশপুর পঞ্চায়েতের হুদোপাড়া, মলুয়াপাড়া, রাঙিয়ারপাতা এবং মহোখোলা গ্রামের পরিস্থিতিও একই। প্রতিটি গ্রামেই সময়ের বাঁধনে বাঁধা তাঁদের জীবন।
কুলোপাড়ার বাসিন্দা খোকন মণ্ডল বলেন,আমরা বিএসএফের নিয়ম মেনে চলি। সম্পর্কও ভালো। কিন্তু উৎসবের দিনে মনটা খারাপ হয়ে যায়। অন্যরা যখন রাতভর ঠাকুর দেখেন, আমাদের তো রাতের বেশি ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সুবীধা নেই।তখন দূর থেকে আলো দেখে মনে মনে আনন্দ করার চেষ্টা করি।
যদিও মহোখোলা গ্রামে কাঁটাতার নেই। সেখানকার বাসিন্দারা কিছুটা স্বস্তিতে। স্থানীয় বাসিন্দা নিহার বিশ্বাস জানালেন,আমাদের গ্রামে বহু পরিবারের বসবাস। কাঁটাতার না থাকায় আমাদের তেমন সমস্যা হয় না। তবে পাশের গ্রামগুলোর দুঃখ আমরা প্রতিদিন দেখি।
বিএসএফের এক আধিকারিক জানান,নিয়ম অনুযায়ী সকাল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সীমান্তের গেট খোলা থাকে। আটটার পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। চাষবাস করা মানুষদের রাতের ট্রেনে ফেরার সময়ে পরিচয়পত্র দেখালে ঢুকতে দেওয়া হয়। তবে একমাত্র আপৎকালীন পরিস্থিতিতেই রাতের বেলায় গেট খোলা হয়।
পুজোর ক’টা দিন সীমান্তের ওপারের গ্রামে ভিন্ন রকম আবহ তৈরি হয়। চারপাশের শহরে ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনি, উল্লাস ভেসে আসে কানে, কিন্তু গ্রামে নেমে আসে এক অদ্ভুত নীরবতা। উৎসবের আলো যেন কাঁটাতারের গেটের ওপারেই আটকে থাকে।গ্রামের প্রবীণ এক বাসিন্দা বলেন,আমাদের বাচ্চারা কখনও রাতভর ঠাকুর দেখার সুযোগ পায়নি। পুজোর গল্প শুনে বড় হচ্ছে ওরা। এপারের আনন্দ আমাদের কাছে কেবলই গল্পের মতো।পুজোর চারদিন কাঁটাতারের একপাশে আলো আর অন্যপাশে অন্ধকার—ভাগ হয়ে যায় দুই জগত।