• বৃত্তান্ত তিস্তাপারের, বারোমাস্যা দুর্গার
    আনন্দবাজার | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • মুক্তির পথ খুব সোজা নয়। সে পথ ছেড়ে দিলে কিছু থাকে না। ভাবছিলেন শেফালি। নীল আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে। কখনও ডানা মেলে উড়ে যায় পাখি। বক, শালিক, ঘুঘু, বৌ কথা কও, দোয়েল, মাছরাঙা, টিয়া— কত কী। নদীর চরের খেতে ফসলের লোভে আসে পাখিরা।

    আকাশের নীলিমা বড় শূন্য করে বুকের ভিতরটা। শরতের এই সময়টা মাঠ-জমি পেরিয়ে দক্ষিণের চরটায় গেলে কাশের বন। বড় মায়াময়। খোলা আকাশের নীচে চর জুড়ে সাদা কাশফুল— মেঘ বলে ভ্রম হয়। স্থানীয় ভাষায় ভাবনি বলে। সাদা ফুলটা মরে এলে কেটে নিয়ে যাবে পুরুষ-মহিলার দল, ঘর ছাইতে।

    পুজোর আর দেরি নেই। তাতে কী! মন ভাল না থাকলে বাইরের আনন্দ মলিন লাগে। শেফালির সেটাই হয়েছে। সংসারের সার বুঝেছেন। গান গেয়ে বড় হওয়ার স্বপ্নটা আজও পূরণ হয়নি। মন তাই উদাসী।

    শেফালির মতোই লড়ছেন এই তিস্তাচরের একাদশী, সোনালি, জয়া, ববিতা, ভূমিকারাও। একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাওয়া। পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে তাঁরাও লড়াই করেন। বর্ষায় খরস্রোতা তিস্তায় ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ করেন জ্বালানির জন্য। কাকভোরে উঠে বা সন্ধ্যার অন্ধকারে খেতের কাজে হাত মেলান। কখনও ছাগল-গরুর খাবার বন্দোবস্ত করা, জলে ভিজে পাট নিড়ানো, কত কী। ‘সকলে মিলে সাহায্য না করলে খাব কী? কাজ ছাড়লে বিপদ বাড়বে!’— বলছিলেন উত্তরা, রিতার মতো তিস্তাপারের দুর্গারা।

    জলপাইগুড়ি শহরটার এক ধারে, পূর্ব দিক ঘেঁষে, তিস্তার গতি বরাবর মাইলের পর মাইল এই চর। নদী বরাবর বাঁধ শহর আর চরটাকে আলাদা করেছে। নেতাদের হাত ধরে চর বসতিতে ভরেছে। নদী দূরে সরলেও বর্ষায় কয়েক কিলোমিটার চর পেরিয়ে একাদশী, রিতাদের দাওয়ায় এসে ঠেকে। বিছানা, প্যাঁটরা বেঁধে তখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হয়।

    পিছিয়ে পড়া মানুষের এলাকা বলেই লোকে তাচ্ছিলের চোখে দেখে একাদশী, ভূমিকা, সোনালিদের। শহরের বাড়িগুলোয় কাজ করেন কেউ, কেউ সেলাই করে সংসার চালান। ওঁরা জানেন, এই লড়াই তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

    শেফালির গলায় ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির সুর বাসা বেঁধেছে— আমার গহীন গাঙের নাইয়া... কাজল ভ্রমরা রে...। কাশবনে তিস্তার বিক্ষিপ্ত স্রোতে বয়ে চলা নৌকায় বসে গাইছিলেন। লড়াই করে রাজ্যস্তরে পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু এ ভাবে ভেসে কত দূর যাবেন? দিশেহারা লাগে। লোকে এখন মোবাইল ফোনে গান গেয়ে ছাড়ে। শেফালি অত বোঝেন না। ঠিক করেছেন, এ বছর পুজোয় গান করবেন না। মনটা তাই ভাল নেই।এত দিনের চেষ্টা ছেড়ে দেবেন? বিয়ের পরে চরে এসেই গান রপ্ত করেছিলেন। লোকের বাড়িতে কাজ করেছেন। চায়ের দোকান চালিয়েছেন। এখন সেলাই করে রোজগার। স্বামী জগদীশের একটা সাইকেলের দোকান, বাঁধের উপরে। ছেলেরও সংসার হয়েছে। এখন গানের জন্য ছোটাছুটি লোকে ভাল নজরে নেয় না। সঙ্গে যাঁরা ঢোলক বাজান, দোতরা বাজান, সেই বলরাম, বাঙরু রায়রা গাইতে পীড়াপীড়িও করছেন। ঘুম আসে না শেফালির। তিস্তার চর বড় রহস্যময়ী। গভীর রাতে জ্যোৎস্না মেখে যখন নদী বিশ্রাম নেয়, দূর থেকে ভেসে আসা দোতারার ক্ষীণ শব্দটা তখন মন জাগিয়ে তোলে। মন বলে— নাহ্! ছেড়ে দিলে হবে না!

    বলরাম, বাঙরুদের ডাকেন শেফালি। বলেন, ‘‘আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। সংসারের বাধায় গান ছাড়তে পারি না!’’ নদীর বুকে অন্ধকার নামলে দূরে তিস্তা সেতুর আলোগুলো তারার মতো জ্বলজ্বল করে। গভীর রাতে সেতু দিয়ে ট্রেন যাওয়ার শব্দ। চরের বাতাসে পাক খেয়ে প্রতিধ্বনি ছড়ায়। ঘুম আসে না শেফালি, একাদশী, বলরাম, বাঙরুদের।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)