অভিমানী কারিগর। বলেন, ‘‘দু’-দু’টো মেয়েই তো মায়ের মুখ দেখতে পারে না। আমি বাপ হয়ে কেমন করে মণ্ডপে ঢুকব!...হাঁটতেই জানল না! তো সাইকেল চালানো! ’’
নিমতলা রোডে তখন সাইকেলে বোঝাই শাপলা নিয়ে যাচ্ছেন মেয়েরা।
সাতসকালের টানা বৃষ্টি চাকদহ স্টেশনের পাশের দীর্ঘ পথকে ডুবিয়ে দিলেও বেশ অনেকটা ভিতরে লোহা সরমস্তপুর গ্রামে জল নেই। রোদ্দুর উঠতেই তাই বাঁশ বাঁধতে শুরু করেছিলেন সমীর দাস। দুই কন্যার পিতা।
কাজ সেরে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পেরিয়ে মফস্সলের গলি। দু’পাশে ছোট ছোট বাড়ি। সবুজের ফাঁকফোঁকর দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা ধরে যেখানে থামা গেল, সেই বাড়ির সদর বাঁশের। টালির উপরে কালো পলিথিন বিছিয়ে ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে পড়া আটকানোর নিখুঁত চেষ্টা।
পলেস্তারা করা রংহীন ঘরে সিমেন্টের মাটিতে গ্যাসের চুল্লি, গুটি কয়েক বাসন, প্লাস্টিকের চেয়ার। দুই কামরার বাড়ির ভিতরের ঘরের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিছানা। সেখানেই পা ছড়িয়ে বসে কিশোরী। যার মেরুদণ্ড বেঁকে ফুলে আছে পিঠ। তার পাশেই শুয়ে এক বালিকা। শুয়েই থাকে সে। না তুলে ধরলে বসতে পারে না। হাতে ভর দিয়ে যত ক্ষণ পারা যায়, তত ক্ষণই বসে থাকে।
দুই মেয়ের মা পার্বতী।
জানালেন, কিশোরী প্রিয়াঙ্কার বয়স ১৩। এ ভাবেই দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকে সে। ক্লান্ত হলে শুইয়ে দিতে হয়। নিজে পাশ ফিরতেও পারে না। ছোটটির বয়স চার। নাম বিপাশা। দু’জনেরই জিনঘটিত বিরল রোগ— স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) টাইপ টু।
দুই মেয়েকে নিয়ে বেঁধে বেঁধে রয়েছেন সমীর আর পার্বতী। পার্বতী ঘরেই থাকেন। একা মা পারেন না দুই মেয়েকে সামলাতে। তাই এলাকার বাইরে কাজের খোঁজে যান না সমীর। স্থানীয় এলাকায় মণ্ডপ বাঁধার ডাক পেলে যান। তবে সেই কাজ তো থাকে না নিয়মিত।
স্থানীয় জুনিয়র হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না। যে দিন বাবা পারেন, সেদিন স্কুটিতে বসিয়ে কাছের স্কুলে নিয়ে যান। কোলে করে মেয়েকে ক্লাসঘরে বসিয়ে আসেন ১১টা নাগাদ। টিফিনের ঘণ্টা বাজলে নিয়ে আসেন মেয়েকে। তার বেশি সময় বসে থাকতে পারে না প্রিয়াঙ্কা। পড়াশোনা করতে ভাল লাগে? ঘাড় নাড়ে মেয়ে। কোন বিষয় বেশি ভাল লাগে? লাজুক হেসে উত্তর, “ভূগোল।” ক্লাসে প্রথম হয় সে। দ্বিধা নিয়ে মা বলেন, “ছাত্রীর সংখ্যা ওর ক্লাসে কম। তাদের মধ্যে প্রথম হয়। ওর আর তো কিছু করার নেই। বই নিয়েই তাই থাকে। তবে ছোটটা পড়াশোনা করতে চায় না। দিদির কথাও শুনতে চায় না।”
দুই ভাগ্নীর কষ্টের কথা ভেবে পাশের পাড়ায় থাকা মামা শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো, বোনের ঘরের পাশেই। হই হই করে পাড়া থেকে চাঁদা তুলে পুজো চলল কয়েক বছর। কিন্তু দুর্ঘটনায় পার্বতীর সেই দাদার মৃত্যু হলে বন্ধ হল পুজো।
তার পর থেকে পুজোয় দুর্গার মুখ দেখার আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে প্রিয়াঙ্কাদের। কারও ভ্যান নিয়ে তাতে দুই মেয়েকে বসিয়ে প্রতিমা দর্শন করাতে বেরোন সমীর। “কিন্তু ভিড় ঠেলে মণ্ডপে ঢোকাতে পারি না। কখনও পুলিশকে বলে হয়তো মণ্ডপের কাছে পৌঁছে যেতে পারি, ওই পর্যন্তই। যাঁর জন্য মণ্ডপ বানাই, তাঁর মুখ দেখার অধিকারই যেন নেই!”
এত অভাবের সংসার, তবু বাড়িতে বিশ্বকর্মা পুজো করেন দম্পতি। মূর্তি এনে, পুরোহিত ডেকে, কাঁসর-ঘণ্টায় গমগম করে বছরের ওই একটা দিন। নতুন জামাও ওই দিনই পরা হয়ে যায়। পার্বতী বলেন, “ওদের কোনও আনন্দই দিতে পারি না। ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, ভাল খাবার দেওয়া, কিছুই পারি না। ঘরে বিশ্বকর্মার পুজো হলে ওরাও আনন্দ করতে পারে।” কথা শেষ করতে পারেন না কান্নায়। খানিকটা আড়ালে গিয়ে ভেজা চোখে বলেন, “কোথাও যাই না। মেয়ে দুটোকে যেন বাঁচিয়ে রাখতে পারি। সেটুকুই চাওয়া।”