• পুজোর ফাঁকা মাঠ আরও বড় করে নিয়েছেন মমতা, তৃণমূলের পুজোর ভিড়ে টিমটিম করছে বিজেপি, বামেরা গ্যালারিতেই
    আনন্দবাজার | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • শুরুতে অঙ্কটা ছিল ১০ হাজার। বাড়তে বাড়তে সাত বছরে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার। সাত বছর আগে প্রাপক বারোয়ারির সংখ্যা ছিল ২৮ হাজারের মতো। সাত বছরে বাড়তে বাড়তে সেটা পৌঁছেছে ৪৫ হাজারে। উদ্বোধনের সংখ্যায় নজির তৈরি করেছে ২০২৫। কলকাতা এবং জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল মিলিয়ে তিন হাজারেরও বেশি পুজো উদ্বোধন করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    ‘পুজোর মাঠ’ মমতার কাছে কার্যত ফাঁকাই ছিল। কিন্তু তৃণমূলনেত্রী সেই ফাঁকা মাঠে সন্তুষ্ট থাকেননি। নিজেই নিজের মতো করে মাঠ বড় করে নিয়েছেন। যে মাঠের ব্যাপ্তি কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। যে মাঠে তিনিই স্ট্রাইকার, তিনিই মিডিও, তিনিই গোলরক্ষক।

    বাম জমানায় নানা ক্ষেত্রে সিপিএমের ‘সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ’ থাকলেও পুজোয় ছিল না। বামপন্থী হয়ে পুজোর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। সুভাষ চক্রবর্তীর মতো কিছু নেতার উদ্যোগে কিছু এলাকায় স্থানীয় স্তরের কিছু নেতা পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দলগত ভাবে মণ্ডপে মণ্ডপে সিপিএমের উপস্থিতি থাকত না। উল্টে আদর্শের কারণে পুজো থেকে সচেতন ভাবে ‘দূরেই’ থাকত সিপিএম। তাদের উপস্থিতি থাকত (এখনও থাকে) পুজোর মূল মণ্ডপ থেকে কিঞ্চিৎ দূরে রাস্তার ধারে পুজোর গ্যালারিতে। প্রগতিশীল মার্ক্সীয় পুস্তক বিপণন কেন্দ্রে। ফলে পুজোর মাঠ বরাবর মমতার কাছে ফাঁকা থেকেছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ক্রমে সেই মাঠকে তিনি আরও, আরও বড় করেছেন। আত্মতুষ্টিতে ভোগেননি। পুজো উদ্বোধনকে কুশলী রাজনীতিকের মতো জনসংযোগের মঞ্চ করে তুলেছেন।

    ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথম পুজোর আগে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত মমতা দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে ঘুরছিলেন। গভীর রাতে চেতলার একটি আবাসনে হঠাৎই ঢুকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত কনভয়। কয়েকটি আবাসিক সারমেয় ছাড়া সেই সময়ে আবাসনের মণ্ডপ ফাঁকা। কিন্তু মুহূর্তে রটে যায়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আবাসনের পুজো দেখতে এসেছেন। আবাসিকেরা পিলপিল করে চলে আসেন মণ্ডপে। সেই মুহূর্তেই সেই পুজো ‘মমতার পুজো’ হয়ে যায়। সেই ধারা এখনও চলছে।

    তবে বিরোধী নেত্রী থাকার সময় থেকেই মমতা পুজোর বিষয়ে নিষ্ঠাবতী। সেই পর্বেও কলকাতার কিছু পুজোয় তিনি যেতেন। আর জেলার পুজোয় শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতেন। ২০০৪ সালের পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু জেলার নেতা কালীঘাটে এসে মমতার ভিডিয়োবার্তা রেকর্ড করে নিয়ে যেতেন। তার পরে তা সিডি-র মাধ্যমে দেখানো হত প্যান্ডেলে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তা আরও অনেক বড় আকারে উপস্থাপিত করেছেন মমতা। ফলে পুজোর ময়দানে তিনি একাই দাপিয়ে বেড়ান প্রতি বছর। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মঙ্গলবারের দুর্যোগের কারণে কলকাতার পুজোমণ্ডপে উদ্বোধনী কর্মসূচি বাতিল করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু ‘ভার্চুয়াল উদ্বোধন’ সূচি মেনেই হয়েছে। বুধবার থেকে আবার মমতা পুজোর পথে।

    বিজেপি যে সনাতনী হিন্দুত্বের অভিমুখ নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্রে শান দিতে চাইছে, তাতে পুজো তাদের কাছে একটি বিশুদ্ধ ‘হাতিয়ার’ হতে পারত। কিন্তু মমতা তা আগেভাগে ভোঁতা করে দিয়েছেন। শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা কলকাতা বা জেলার পুজো উদ্বোধনে যাচ্ছেন না, তা নয়। কিন্তু সেই সংখ্যা হাতেগোনা। কলকাতায় একমাত্র সজল ঘোষ ছাড়া বিজেপির হাতে কোনও বড় পুজো নেই। ফলে তৃণমূলের পুজো এবং উদ্বোধনের ভিড়ে বিজেপি টিমটিমে। সেই প্রসঙ্গেই আবার আলোচিত হচ্ছে নিচুতলার সংগঠনের জোরের কথা। পুজো উদ্বোধন করাতে হলে সেই বারোয়ারিতে স্থানীয় স্তরের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তৃণমূলের তুলনায় এখনও পর্যন্ত বিজেপি সেই অঙ্কে নেহাতই শিশু।

    শুধু উদ্বোধন নয়, মমতা পুজোর মাঠ আরও বাড়িয়েছেন ক্লাবগুলিকে অনুদান দিয়ে এবং কার্নিভাল চালু করে। মমতার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ব্রাজ়িলের রিও ডি জেনেইরোর ‘রিও কার্নিভাল’ থেকে মমতা এই দুর্গাপুজোর কার্নিভালের কথা প্রথম ভেবেছিলেন। যা বছরের পর বছর ধরে হতে হতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে নিয়েছে। এ বারেও যখন একের পর এক পুজো উদ্বোধন করছেন মুখ্যমন্ত্রী, তখন তাঁর অধীনস্থ তথ্যসংস্কৃতি দফতরের তত্ত্বাধানে রেড রোডের দু’পাশে আগামী ৫ অক্টোবরের কার্নিভালের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।

    উল্লেখ্য, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই পুজোর অনুদান দেওয়া শুরু করেননি মমতা। তিনি সেই অনুদান শুরু করেছিলেন ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসারও দু’বছর পর, ২০১৮ সাল থেকে। লক্ষণীয়, ২০১৪ সালে বিজেপি দেশের ক্ষমতায় আসার পরেও পুজোয় অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি মমতা। অনুদান চালু করেছেন ২০১৮ সাল থেকে, যখন বাংলার রাজনীতির বিরোধী পরিসরে বাম-কংগ্রেসের বদলে বিজেপি মাথা তুলতে শুরু করেছে। যে বিজেপির রাজনৈতিক ভাষ্য আবর্তিত হয় হিন্দুত্বকে ঘিরেই। রাজনৈতিক মহলের অনেকে অনুদান প্রাপক বারোয়ারির সংখ্যাকে আরও একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে বুথসংখ্যা ৮০ হাজারের কিছু বেশি। তার মধ্যে পুজোর অনুদান পাচ্ছে ৪৫ হাজার কমিটি। অর্থাৎ, গড় করলে দেখা যাবে প্রতি দু’টি বুথ পিছু একটি কমিটি মমতার দেওয়া পুজো অনুদান পাচ্ছে। পাশাপাশিই মমতা বঙ্গসমাজের কাছে তাঁর এই বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছেন যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। সেই উৎসবের সুতোয় গোটা বাঙালি সমাজকে বেঁধে ফেলার ভাবনাও ছিল পুজো অনুদানের নেপথ্যে।

    প্রথম বার পুজো অনুদানের অঙ্ক ছিল ১০ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৫ হাজার টাকা। কোভিড পর্বে (২০২০ এবং ২০২১ সালে) এক লাফে ৫০ হাজার টাকা করা হয় পুজো অনুদানের অর্থ। ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে অনুদান দেওয়া হয় যথাক্রমে ৬০, ৭০ এবং ৮৫ হাজার টাকা। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার আগে এ বার অনুদানের অঙ্ক পৌঁছেছে ১ লক্ষ ১০ হাজারে।

    পুজো অনুদানের পাশাপাশি পুজো কমিটিগুলিকে বিদ্যুতের বিলেও ছাড় দেওয়া হয়েছে। সেই ছাড়ের পরিমাণও বছর বছর বেড়েছে। যেমন বেড়েছে মমতার পুজো ময়দানের পরিধি।

    পুজোয় অনুদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, অতীতে কি বাংলায় পুজো হত না? পুজোয় কেন সরকার টাকা দেবে? মামলা হয়েছে আদালতে। কিন্তু মমতা তাঁর নিজের তৈরি করা জমি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন বাঙালি অস্মিতাকে। ইউনেস্কো বাংলার দুর্গাপুজোকে আবহমান ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। যাকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিপণন করেছেন মমতা।

    পুজোর মাঠ ফাঁকা পেলেও মমতা আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকেননি। সে মাঠকে নিজেই আরও বড় করে নিয়েছেন। সেখানে তিনিই স্ট্রাইকার, তিনিই মিডিও, তিনিই গোলরক্ষক। বিজেপি-সহ বাকিরা গ্যালারিতে বসে পুজোর খেলা এবং আলোর মেলা দেখছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)