পুজোর মধ্যেই তুঙ্গে উঠছে কলকাতায় বিপর্যয় ঘিরে বিতর্ক। আকাশভাঙা বৃষ্টির পরে শহর প্লাবিত হয়ে যেতেই গঙ্গা দিয়ে বয়ে আসা ভিন্ রাজ্যের জলের দিকে আঙুল তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার তাঁর নতুন ঘোষণা, ক্ষমতায় ফিরে এলে তাঁদের সরকারও অন্যদের দিকে জল ঠেলে দেবে! কারণ, রাজ্যকে বাঁচতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর এমন সব মন্তব্যের উল্টো দিকে রাজ্য ও পুর-প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে সুর চড়াচ্ছে বিরোধীরাও। উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফার দাবিও।
জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। তাঁদের পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও হোমগার্ডের চাকরির আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সিইএসসি-র এমডি বিনীত সিক্কা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে সম্মান জানিয়ে শহরে প্রবল বৃষ্টির কারণে প্রত্যেক মৃতের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁদের সংস্থা।
চতুর্থীর (তিথির জেরে এ বার দু’দিন চতুর্থী পড়েছে) বিকালে নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘে বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের পুজো উদ্বোধনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ফের কেন্দ্র ও অন্যান্য রাজ্যকে নিশানা করে বলেছেন, “এত বৃষ্টি জীবনে হয়নি। ফরাক্কা, বিহারের সব জল গঙ্গায় এসে ঢুকেছে। ফরাক্কায় ড্রেজ়িং হয় না। কলকাতা বন্দর, ডিভিসি, মাইথন ড্রেজ়িং করে না। ওদের ছাড়া জলে আমরা ডুবি। শুধু বড় বড় কথা বলে!” এই সূত্রেই তাঁর আরও বক্তব্য, “বাংলায় সাড়ে ৫ লক্ষ পুকুর কাটা, ৫০০ চেক-ড্যাম তৈরি হয়েছে। তাই জলটা বার করে দেওয়া যায়। এর পরেও ড্রেজিং না-করলে, আর যদি আপনাদের আশীর্বাদে ফিরে আসতে পারি, তা হলে আমি জানি কী করতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা করব। আমার দিকে জল ঠেললে আমিও তোমাদের দিকে জল ঠেলে দেব! আমাদেরও তো বাঁচতে হবে!’’
বিরোধীদের এক হাত নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন দৃষ্টান্ত টেনেছেন লন্ডনেরও। তাঁর মন্তব্য, “লন্ডনেও জল জমলে ১০ দিন, দিল্লিতে ৫-৬ দিন থাকে। মহারাষ্ট্রেও থাকে। আমরা মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করি না। মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। যাঁরা মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁরা আয়নায় মুখ দেখুন!”
বিরোধীরাও এক যোগে সরকারকে পাল্টা নিশানা করেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, “মানুষ জলের মধ্যে বেরিয়ে অপরাধ করেছেন? আর কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা সত্ত্বেও মানুষকে সতর্ক করেননি, আপনারা চরমতম অপরাধ করেছেন! কলকাতা উধাও হয়ে, লন্ডনের থেকে আরও এগিয়ে গিয়েছে। কাল ১১টা লোক মারা গিয়েছেন, আর উনি (মুখ্যমন্ত্রী) লাঠি খেলছেন! ওঁর ৭২ ঘণ্টা মৌনীব্রতে থাকা উচিত ছিল!” বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য এ দিন মানিকতলায় ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে দুর্গত বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানেই শমীক বলেছেন, “বার বার পুরপ্রতিনিধিদের জানানো সত্ত্বেও, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাপনে সরকার বা কোনও সংস্থা কিছু করেনি। পুজোর আগে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সামগ্রী নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর মানুষের আদালতে প্রতিষ্ঠিত, এটা প্রশাসনিক বিপর্যয়। এটা তৃণমূলের অপদার্থতা।”
খাস কলকাতায় বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে কংগ্রেস। কলকাতা ও বিধাননগর পুরসভার দুই মেয়রকে কেন সরানো হবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছে তারা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলেছেন, ‘‘আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস ছিল। তার পরেও কোনও আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হল না। পুজোর মুখে এতগুলো মানুষ জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলেন, তাঁদের কোনও কসুর ছিল না। সারা দেশ দেখেছে, কলকাতার রাস্তায় লাশ ভাসছে! মুখ্যমন্ত্রীকেই এর দায় নিতে হবে। প্রশাসন কাজ করছে না। হয় বিকল্প ব্যবস্থা করুন, নয়তো ইস্তফা দিয়ে দায়িত্ব ছাড়ুন!’’ জমা জলে ভোগান্তি, রাস্তার বেহাল দশার প্রতিবাদে এ দিনই প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে কলকাতা পুরসভার ১০ নম্বর বরোর দফতরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্ররাজ চট্টোপাধ্যায়দের নেতৃত্বে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা।
রাজ্যসভার সিপিএম সাংসদ তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, “অস্বীকার করার উপায় নেই, নজিরবিহীন বৃষ্টিতে জল জমতে পারে। অতীতেও কলকাতায় এমন বৃষ্টির ফলে জল জমেছে। কিন্তু বৃষ্টির পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাতে জল না-দাঁড়িয়ে থাকে, কার্যকর নিকাশি-ব্যবস্থা থাকে, সেটা নিশ্চিত করা নাগরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। এক দিকে, পাম্পিং স্টেশন ঠিক মতো কাজ করছে না। আর প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য কলকাতার প্রাকৃতিক নিকাশি-ব্যবস্থা, জলাভূমি বুজিয়ে নির্মাণ ব্যবসা হচ্ছে। কারণ, তৃণমূলের নেতারা কাটমানিতে যুক্ত।”