নিজের কোনও ছবিই কখনও দেখিনি, ‘রক্তবীজ’ও না, একমাত্র ‘ঘরে বাইরে’ দেখেছিলাম: ভিক্টর
আনন্দবাজার | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রশ্ন: সাক্ষাৎকার দিতে চান না, সাংবাদিকদের কেন পছন্দ নয় আপনার?
ভিক্টর: কাউকে অসম্মান করতে চাই না। কিন্তু অনেকেই এসে প্রশ্ন করেন, আমার প্রথম ছবির নাম কী। সাক্ষাৎকারের আগে এইটুকু পড়াশোনা যদি না করেন, তা হলে কি চলে? তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। তাই নিজের সময় নষ্ট করতে চাই না।
প্রশ্ন: ইদানীং তো এটাই ধারা, ছবি মুক্তি পাওয়া মানেই একের পর এক সাক্ষাৎকার।
ভিক্টর: আমি এই সব ‘ধারা’ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবি না। নিজের মতো পাহাড়ে থাকি। নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশে।
প্রশ্ন: পাহাড় প্রসঙ্গেই বলি, হড়পা বান, ধসের ফলে হিমাচলে মানুষদের খুব খারাপ পরিস্থিতি। এই ঘটনা কি মনে প্রভাব ফেলেছে?
ভিক্টর: এটা আমার পক্ষে বোঝানো খুব কঠিন। একটু অন্য ভাবে বোঝাই?
প্রশ্ন: হ্যাঁ, অবশ্যই ।
ভিক্টর: রুদ্রপ্রয়াগের কাছে গৌচর বলে একটা শহর আছে। সেখানে গিয়েছিলাম আমি। সেখানে ধসের ফলে একটা পরিবার পাহাড়ের তলায় চলে যায়। মা-বাবা আর তিন সন্তানের পরিবার। প্রয়াগ মানে দুটি নদীর মিলনস্থল। প্রতি বার গেলে আমি ওখানকার একটি হোমস্টে-তে উঠি। সে বারও ওখানেই ছিলাম। যেখান থেকে প্রয়াগ স্পষ্ট দেখা যায়। সন্ধ্যাবেলা দেখি, ওখানে পাঁচটা চিতা সাজানো হচ্ছে। খবর নিলাম। জানতে পারলাম, পাঁচ জনের পরিবারকে দাহ করতে ওখানে নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু ওখানে তো খুব বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির জলে চিতার আগুন নিবে গেল। শেষে মরদেহ টেনে টেনে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। এই ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। পাহাড়ে এক নিমেষে যে কী ঘটে যায় তা বোঝা যায়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য করতে গেলে সেই জায়গায় নিজে গিয়ে করতে হবে। টাকাপয়সা দিয়ে কিছু হবে না।
প্রশ্ন: আপনি তো বহু বছর পাহাড়ে থাকেন। বয়স হলে শহরের কাছে থাকতে চান অনেকেই। আপনি কেন শহর থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন?
ভিক্টর: আমার বেড়ে ওঠাই তো চা বাগানে। আমার ভাই-বোন কেউ ছিল না। মানুষ হয়েছি একা। শিলংয়ে বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছি। বৃষ্টি, ফুটবল, একা থাকা আমার বরাবরের অভ্যাস। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় সবাই নিরিবিলি কিছু খোঁজে। একা থাকার জন্য সাহস লাগে। পুজোর সময় অবশ্য শহরে থাকা অন্য রকম। কিন্তু পুজো কেটে গেলেই চলে যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন: একা থাকার এই অভ্যাসের কারণে কখনও কি অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়?
ভিক্টর: আসলে ভাই-বোন ছিল না। তাই আমার কখনও কিছুতে ভাগ বসেনি। সারা জীবন একা কাটিয়েছি। তাই মানিয়ে নেওয়ার পর্যায়ে যায়নি কিছু। তবে বন্ধুবান্ধব অনেক ছিল। প্রচুর ফুটবল খেলেছি।
প্রশ্ন: আপনি তো নিজের ছবি দেখেন না। ‘রক্তবীজ’ দেখেছিলেন?
ভিক্টর: কোনও ছবি দেখিনি আজ পর্যন্ত। ওটাও দেখিনি। ‘রক্তবীজ ২’-ও দেখব না।
প্রশ্ন: কেন দেখবেন না ?
ভিক্টর: ইচ্ছা করে না। আজ পর্যন্ত ‘দুই পৃথিবী’ ছবিটাই দেখলাম না। তা হলে আর কোন ছবি দেখব। একটাই ছবি দেখেছিলাম ‘ঘরে বাইরে’। বাকি এত ছবিতে অভিনয় করেছি যেমন ধরুন ‘লাঠি’, ‘একান্ত আপন’ কোনওটাই দেখিনি।
প্রশ্ন: ‘লাঠি’ নিয়ে তো এখনও আলোচনা হয়। প্রভাত রায়ের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
ভিক্টর: হ্যাঁ, এই কয়েক দিন আগে ফোনে কথা হল। আমি ওকে খুব ভালবাসি।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত ভাবে তা হলে অনেকের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ। তা হলে সমাজমাধ্যমে নেই কেন আপনি? আপনার সমসাময়িক অনেক অভিনেতা কিন্তু ভীষণ সক্রিয়।
ভিক্টর: না শখ আছে, না প্রয়োজন। সবটাই সময় নষ্ট বলে আমার মনে হয়। যাঁদের কোনও কাজ নেই তাঁরাই বরং করুন সোশ্যাল মিডিয়া।
প্রশ্ন: কিন্তু বাংলা ছবি এখন অনেকটাই এই সমাজমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে কী ভাবে দেখেন?
ভিক্টর: পরিবর্তনকে তো মানতেই হবে। সবটাই যে খারাপ তা বলতে চাই না। নতুন প্রজন্মের কাঁধেই সব ভার। ওরা যে ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। আর যেটা হবার সেটা হবেই। নতুন প্রজন্ম এখন নৌকা টানবে। আর আমরা বসে দেখব।
প্রশ্ন: খ্যাতি পাওয়ার পর সব কিছু থেকে নির্লিপ্ত থাকা খুব কঠিন ব্যাপার তারকাদের পক্ষে। আপনি এই অনুশীলন করলেন কী ভাবে?
ভিক্টর: শিলংয়ের মানুষ খুব ভাল গান গায়। পাঁচ বছর বয়সেই আমি ওখানে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলাম গানের জন্য। সেই বয়স থেকে খ্যাতি পেয়েছি, ভালবাসা পেয়েছি। আর ছোটদের মধ্যে আজ আমি এক নম্বরে তো কাল অন্য কেউ। স্কুলে যখন নাটক করতাম তখন এক দিন আমি হতাম গল্পের নায়ক। পরের দিন অন্য কেউ নায়ক। সবসময় হিরো হয়ে থাকতে হবে সেটা কোনও দিন মনে করিনি, পাত্তাও দিইনি। অভিনয়জীবনের প্রথমে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছি। কখনও ভয় পাইনি।
প্রশ্ন: কেমন সম্পর্ক ছিল আপনাদের?
ভিক্টর: তখন পীযূষ বসুর পরিচালিত ‘দুই পৃথিবী’ ছবির শুটিং করছি। একটা দৃশ্যে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। পরিচালক বললেন পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছিলাম। বলেছিলাম এই দৃশ্যে পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। তার পাঁচ-ছ’দিন পরে এমনই এক দৃশ্য। যেখানে আমি উত্তমকুমারে পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইছি। পরিচালক বললেন, কী, শিখে গিয়েছিস! নতুন হলেও আত্মসম্মান বিসর্জন দিইনি। বলেছিলাম, যেখানে প্রয়োজন, সেখানে পা ধরব।
প্রশ্ন: মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে আপনি দেশ-বিদেশের ছবি, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের ছবিতে সমানতালে কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। ভারসাম্য বজায় রাখতেন কী ভাবে?
ভিক্টর: চরিত্র পরিবর্তন হল খানিকটা জামাকাপড় বদলানোর মতো ব্যাপার। একটাকে ফেলে আর একটাকে নিজের অঙ্গে চাপিয়ে নেওয়া। জীবন খুব আনন্দের। কাজের মধ্যে সেই আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। তা হলে সব সম্ভব। আমি একেবারেই গুরুগম্ভীর শিল্পী নই।
প্রশ্ন: পাহাড়ে সারাটা দিন কী ভাবে কাটান?
ভিক্টর: এই বয়সে সারা দিন বই পড়ি। আর ইন্টারনেট তো আছেই। গুগ্লকে সারা দিন প্রশ্ন করি। আমার জীবনে প্রচুর প্রশ্ন আছে। তাই খুঁজতে থাকি। দর্শন, শিল্প— কত কী!
প্রশ্ন: পেন্টিংস, ঐতিহাসিক জিনিসপত্র সংগ্রহের শখ আছে আপনার, তাই না?
ভিক্টর: অল্পস্বল্প আছে। ধুর, ছাড়ুন তো। এ সব কোথা থেকে জানলেন আপনি? আমার সম্পর্কে কিন্তু অনেকে মিথ্যে কথাও বলেন। সেগুলো থেকে কিন্তু সাবধান।
প্রশ্ন: কী মিথ্যা কথা শুনেছেন?
ভিক্টর: যত দূর মনে পড়ছে, তখন আমি অসমে। বহাল তবিয়তে বসে। জানতে পারলাম, আমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে। আমায় তো প্রায় চিতায় তুলে দিয়েছিল সকলে!
প্রশ্ন: তা হলে তো আপনার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছিল, ভালই তো!
ভিক্টর: তা বটে। মানুষ শরীরচর্চা কেন করে? সুস্থ থাকার জন্য। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মানুষ যে বেঁচে থাকবে, সারা জীবন কি তরুণ হয়ে বাঁচবে! বুড়ো হয়ে বাঁচবে। ফলে আমার থেকে শিখে নাও, বেঁচে কোনও লাভ নেই। খেয়েদেয়ে আনন্দ করে যত শীঘ্র মরবে, তত আরামসে যাবে। ধুঁকতে ধুঁকতে লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াব, তা হলে ব্যাঙেও লাথি মারবে। সে বয়সে যেন পৌঁছোতে না হয় মানুষকে। সুতরাং আবোল-তাবোল খাওয়া উচিত। সুখে যাতে মরতে পারি।
প্রশ্ন: আপনি সব ধরনের খাওয়া-দাওয়া করেন?
ভিক্টর: আমি বিশেষ কোনও নিয়ম মানি না। ভাতের পাতে প্রথমেই থাকে গাওয়া ঘি আর নুন।
প্রশ্ন: আপনার সহ-অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়ও প্রচারবিমুখ। আপনার পথে তিনিও হাঁটছেন বলে কি মনে হয়?
ভিক্টর: আমার মতো যেন কেউ না হয়। আমি অদ্ভুত মানুষ। আর সাংবাদিকদের যদি দূরে সরিয়ে রাখতে ভালবাসে তো রাখুক।
প্রশ্ন: আগেও এই প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। শহরে আরও অনেক প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে। তাদের সঙ্গে কাজ করবেন না?
ভিক্টর: এ মা! কেন করব না? সকলের সঙ্গে কাজ করব। এই সাক্ষাৎকার পড়ে যদি দল বেঁধে প্রযোজকেরা আসেন আমার কাছে, চরিত্র পছন্দ হলেই রাজি হয়ে যাব।
প্রশ্ন: এই পুজোয় ছবি মুক্তি পাচ্ছে। কলকাতায় থাকবেন?
ভিক্টর: না। প্রতি বছরের মতো এ বারও দেহরাদূনেই কাটবে। রামকৃষ্ণ মিশনে সুন্দর ভাবে পুজো হয়। কোনও ভিড় নেই। সময়মতো অঞ্জলি হয়। দারুণ ভোগ খাওয়ায়। অষ্টমীর দিন ভোগ খাব। গত ১৩ বছর ধরে আমার এক বন্ধু শয্যাশায়ী। তাঁর জন্য প্রতি বছর টিফিন ক্যারিয়ারে ভোগ নিয়ে যাই। আশ্রমের সবাই আমার জন্য তুলে রাখেন। এটাই নিয়ম।