• ছেঁড়া তার, ভাঙা মণ্ডপ পেরিয়েই প্রতিমা দর্শনের চেষ্টা
    আনন্দবাজার | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগে প্রাণপণে মণ্ডপের জল নামানোর চেষ্টা করে চলেছেন কলেজ স্কোয়ার দুর্গাপুজো কমিটির লোকজন। কিন্তু পেরে ওঠা যাচ্ছে না। সুইমিং পুল আর মণ্ডপের জল একাকার। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার পুজোর উদ্বোধন হওয়ার কথা। হন্যে হয়ে পুরসভায় ফোন করে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু এই পরিস্থিতিও যেন বুঝতে নারাজ মণ্ডপ দর্শনে হাজির উৎসাহী জনতা। কেন দর্শনার্থীর প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে, এ নিয়ে চিৎকার জুড়েছেন তাঁরা। এক উদ্যোক্তা বললেন, ‘‘মানুষের জন্যই এত আয়োজন। কিন্তু পরিস্থিতি তো বুঝতে হবে! এতটা অসহিষ্ণু আমরা কবে হয়ে গেলাম?’’

    কলেজ স্কোয়ারে বুধবারের এই চিত্র কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মঙ্গলবারেও জমা জলের মধ্যেই শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে উৎসাহী জনতার ভিড় দেখা গিয়েছে। উৎসবে শামিল সেই জনতার যেন ভাবনাই নেই শহরের পরিস্থিতি, কে কী ভাবে রয়েছেন— সে সব নিয়ে। এখনও শহরের সব এলাকা থেকে জল নামেনি। বহু আবাসন বিদ্যুৎহীন, জলমগ্ন। নিদারুণ সমস্যায় সেখানে থাকা প্রবীণেরা। প্রশ্ন উঠছে, এই পরিস্থিতিতে সহনাগরিক হিসাবে কি কোনও ভূমিকাই স্মরণ হচ্ছে না? এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কাশী বোস লেনে হাজির এক দর্শনার্থীর উত্তর, ‘‘পুরসভা জল নামাতে পারেনি, তার দায় আমরা কেন নেব? আর জি করের ঘটনার পরেও তো উৎসব থেমে থাকেনি।’’

    পরিস্থিতি এমন যে, দর্শনার্থী টানতে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গিয়েছে বলে বার্তা দিতে হয়েছে কাশী বোস লেনের পুজোকর্তাদের। তাঁরা সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, গুজবে কান দেবেন না। পুজো হচ্ছে পুজোর মতোই। এতেই কি ভিড় বাড়ছে? ওই পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি, ‘‘মানুষ না এলে এত আয়োজন করে লাভ কী?’’ যদিও সমাজতাত্ত্বিক থেকে মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এই উৎসব-যাপন আদতে সম্পর্ক-শূন্যতার লক্ষণ।

    জমা জলের সমস্যায় পড়া পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম দমদম পার্ক তরুণ দল। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেই এ দিন দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রেখেছেন তাঁরা। সেখানকার পুজোকর্তা বিশ্বজিৎ প্রসাদ বলেন, ‘‘কেউ এসে বলছেন, বেড়াতে চলে যাব, এক বার দেখতে দিন। কেউ বলছেন, ঘুরতে যাচ্ছি, ঠাকুরটা দেখে যাব না?’’ জমা জলের জন্য টালা বারোয়ারির পুজোর আলোর ক্ষতি হয়েছে। মণ্ডপের পাটাতনের নীচ দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তারেরও ক্ষতি হয়েছে। ওই পুজোর উদ্যোক্তা অভিষেক ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘দ্রুত সব সামলানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু স্কুল ছুটি পড়ে যাওয়ায় প্রচুর মানুষ ভিড় করছেন।’’ মহম্মদ আলি পার্কের মণ্ডপে ঢোকার র‌্যাম্প ভেঙে গিয়েছে জলের তোড়ে। সেই অবস্থায় ছিঁড়ে পড়া তারের উপর দিয়েই দর্শনার্থীরা চলেছেন প্রতিমা দর্শনে।

    দক্ষিণের সিংহী পার্কের পুজোর মঞ্চ ভেঙেছিল জলের তোড়ে। জল জমেছিল বালিগঞ্জ কালচারালের পুজো মণ্ডপে। পরিস্থিতি সামলে এ দিন ওই চত্বরের সব পুজোর উদ্বোধন হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সম্পাদক অঞ্জন উকিল বললেন, ‘‘সামলে যে নেওয়া গিয়েছে, সেটাই বড় কথা।’’

    জমা জলে সব চেয়ে বেশি সমস্যায় বড়িশা সর্বজনীন। মাটি খুঁড়ে তৈরি এই পুজোর মণ্ডপ জলে তো ভরেছেই, ক্ষতি হয়েছে প্রতিমারও। দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করে জোরকদমে কাজ চলছে সেখানে। তার মধ্যেও দেখা গেল, কেউ কেউ মোবাইলের ক্যামেরা চালু করে অবলীলায় ঢুকে পড়লেন মণ্ডপে। সব মিলিয়ে এই উৎসব-যাপন প্রশ্ন রেখে গেল, সহমর্মিতার হুঁশ হবে কবে?
  • Link to this news (আনন্দবাজার)