আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের শহরগুলিকে ডেটা ভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে আধুনিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয়েছিল স্মার্ট সিটিজ মিশন। লক্ষ্য ছিল নাগরিক পরিষেবা দ্রুততর করা, পৌরসভার রাজস্ব বাড়ানো এবং পরিবহন, যান নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য সংগ্রহকে আরও কার্যকর করে তোলা। কিন্তু প্রকল্পের এক দশক পর দেখা যাচ্ছে—সরকারি অর্থে গড়া ডিজিটাল পরিকাঠামো ও নাগরিক তথ্য আসলে শিল্পক্ষেত্রের হাতে চলে যাচ্ছে, নাগরিক স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে ১০০টি শহরে বিভিন্ন সেন্সর, নেটওয়ার্ক ও ডেটাবেস বসানো হয়েছিল। এগুলি থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারস নামে কেন্দ্রীয় কক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষেবা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল। মন্ত্রকের ডেটা স্মার্ট সিটিজ স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী একটি ইন্ডিয়া আরবান ডেটা এক্সচেঞ্জ গড়ে তোলা হয়, যেখানে ৫০টি শহরের তথ্য কেন্দ্রীভূত হয়।
কিন্তু এই তথ্যভাণ্ডার মূলত বেসরকারি সংস্থার হাতে পৌঁছে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভুবনেশ্বরের গণপরিবহন সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে একটি বেসরকারি সংস্থা বাস টিকিটিং ও ট্র্যাকিং অ্যাপ তৈরি করে এবং পরে সেটিকে শহরের পরিবহন সংস্থার কাছে সমাধান হিসেবে বিক্রি করে।
যান চলাচলের তথ্য সংগ্রহ, গাড়ির নম্বরপ্লেট শনাক্তকরণ, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য দেখা গেলেও, যানজট কমানো বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে খুব একটা ফল মেলেনি। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিও প্রায় অদৃশ্য—অ্যাপগুলির মাধ্যমে গাড়ির অবস্থান জানানোর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্জ্য সংগ্রহ বা জরুরি গাড়ির জন্য “গ্রিন করিডর” তৈরির প্রতিশ্রুতিও কাগজেই সীমাবদ্ধ।
জন্ম-মৃত্যু সার্টিফিকেট, সম্পত্তি কর, পৌর রেকর্ড ডিজিটাইজেশনের কাজ চার দশক ধরেই চলছিল। ২০০৬ সালের ন্যাশনাল ই-গভর্ন্যান্স প্ল্যান সেই উদ্যোগকে গতি দেয়। স্মার্ট সিটি প্রকল্প সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করে একক প্ল্যাটফর্মে সার্ভিস সরবরাহ সহজ করে তোলে। অর্থাৎ ডিজিটাল সনদ প্রদান বা বিল সংগ্রহের দ্রুততা আসলে পুরোনো সংস্কারের ফল, নতুন প্রকল্পের নয়।
ইন্ডিয়া আরবান ডেটা এক্সচেঞ্জ–কে সরকার ও শিল্পমহল ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার বলে অভিহিত করছে। কিন্তু বাস্তবে “পাবলিক” কেবল নাগরিকদের তথ্য, যা সরকারি অর্থে সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই তথ্য বিনামূল্যে বা অর্থের বিনিময়ে কতটা, কারা ব্যবহার করছে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট আইন নেই। ফলে সরকারি তহবিল দিয়ে তৈরি পরিকাঠামো ও তথ্য আসলে বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
২০২১ সালে চালু হওয়া ন্যাশনাল আরবান ডিজিটাল মিশন–এর অধীনে উপযোগ নামক একটি একক অ্যাপ নাগরিক পরিষেবা দিচ্ছে। সম্প্রতি ট্রান্সপোর্ট স্ট্যাক প্রকল্পের মাধ্যমে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে গণপরিবহন অ্যাপ চালুর কথাও ঘোষণা হয়েছে। শিল্পমহল দাবি করছে, এভাবেই স্মার্ট সিটির অসমাপ্ত কাজ শেষ হবে। কিন্তু নাগরিক সমাজের বড় অংশের প্রশ্ন—যেখানে স্পষ্ট তথ্য আইনই নেই, সেখানে নাগরিকদের তথ্য কি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য? শহরের গুণগত মানোন্নয়নের নামে সরকারি অর্থে তৈরি পরিকাঠামো আসলে কর্পোরেট মুনাফার পথে কেন ব্যবহার করা হবে?
স্মার্ট সিটি প্রকল্প ও ইন্ডিয়া আরবান ডাটা এক্সচেঞ্জ আজ করিয়ে দিচ্ছে—ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণের নামে সরকারি অর্থ ব্যয়িত হলেও, নাগরিক পরিষেবার উন্নতি সীমিত; বরং নাগরিকদের তথ্যই বেসরকারি সংস্থার হাতে পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—তথ্যভিত্তিক শাসন ও তথাকথিত ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার আসলেই কি শহর উন্নতির উপায়, নাকি নাগরিক তথ্যের বেসরকারিকরণের আরেকটি রূপ?