পুকুরেই ইলিশ চাষের পথে ভারত, বড় সাফল্যের মুখে বিজ্ঞানীরা
আজকাল | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: দুর্গাপুজোর ঢাকের আওয়াজ, ধূপ-ফুলের গন্ধ আর আলোর উৎসবের ভিড়ে যখন সারা বাংলা মেতে উঠবে, তখনই নিঃশব্দে বিদায় নেবে এক অমূল্য সম্পদ – ইলিশ। গ্রীষ্ম ও বর্ষার পর দল বেঁধে নদীতে আসা এই রূপালি মাছ অক্টোবর থেকেই ফের সমুদ্রের পথে রওনা দেয়। সাধারণত বছরে দু’বার ইলিশ ডিম ছাড়তে নদীতে আসে। মূলত লোনা জলে বেড়ে ওঠা এই মাছ বংশবিস্তারের জন্য মিঠে জল খোঁজে, কারণ নোনা জলে ডিম টেকে না।
কিন্তু যদি এই অপেক্ষা না থাকত? যদি সারাবছর বাজারে পাওয়া যেত ইলিশ? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ব্যারাকপুরের আইসিএআর-সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিফ্রি) বিজ্ঞানীরা। তাঁদের বহু বছরের প্রচেষ্টায় পুকুরে ইলিশ চাষের সম্ভাবনা এখন বাস্তব রূপ নিতে চলেছে।
ইলিশকে বন্দি অবস্থায় প্রজননের ধারণা শতাব্দীরও বেশি পুরনো। ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাদুঘরের জার্নালে সুন্দারলাল হোরা লিখেছিলেন, এই মাছ বন্ধ জলাশয়ে টিকে থাকতে এবং পূর্ণাঙ্গ পরিপক্বতা লাভ করতে সক্ষম। পালটা জলশোধনাগারের ট্যাঙ্কে ইলিশের উপস্থিতি নিয়ে তিনি গবেষণাও করেছিলেন।
সিফ্রির গবেষকরা জানাচ্ছেন, গত ৩০-৪০ বছর ধরে এই সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ২০১২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে প্রথম বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। নদী থেকে ইলিশ এনে পুকুরে মানিয়ে নেওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক করে ডিম ছাড়ানো, ডিম নিষিক্তকরণ এবং বাচ্চা ইলিশের পূর্ণ জীবনচক্র সম্পূর্ণ করানোই ছিল লক্ষ্য। কিছু সমস্যার সমাধান মিললেও অর্থাভাবে প্রকল্প থমকে যায়।
২০২১ সালে আইসিএআরের অর্থে তিন বছরের দ্বিতীয় প্রকল্প শুরু হয়। ব্যারাকপুর, কলকাতার উপকণ্ঠ ও কাকদ্বীপে বিভিন্ন ধরনের পুকুরে ছোট ইলিশ ছাড়া হয়। পুরুষ মাছ প্রজননে সক্ষম হলেও স্ত্রী মাছের বৃদ্ধি তুলনায় ধীর ছিল। সাধারণত ১.৫ থেকে ২ বছরে ডিম দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করলেও পুকুরে তা আরও দেরিতে দেখা যায়। বড় মাপের স্ত্রী মাছও বাজারের ইলিশের তুলনায় অনেক ছোট ছিল।
বিজ্ঞানীরা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে মাছের ডিম্বাশয়ের গঠন পরীক্ষা করে দেখেন, শেষ ধাপের আগ পর্যন্ত পরিপক্বতা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে ডিম ছাড়িয়ে নিষিক্তকরণের চেষ্টা করা হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকাশ থেমে যায়। তবুও তাঁরা আশাবাদী, কারণ এ ধরনের গবেষণা দীর্ঘমেয়াদি কাজ এবং বিশ্বের অন্যান্য মাছ যেমন স্যামন চাষে সাফল্য পেতে চার দশক সময় লেগেছিল।
ইলিশপ্রেমীদের বড় প্রশ্ন – পুকুরে চাষ করা ইলিশে নদীর মতো স্বাদ থাকবে তো? গবেষকরা এজন্য স্বাদপরীক্ষা (অর্গানোলেপটিক টেস্ট) চালান। একই উপায়ে রান্না করা নদীর ইলিশ ও পুকুরের ইলিশের পদ খাইয়ে প্রায় ৫০ জনকে মতামত দিতে বলা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, গন্ধ, স্বাদ, টেক্সচার বা সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করছেন, ইলিশের স্বাদ মূলত ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণে হয়, যা মাছ প্ল্যাঙ্কটন খাওয়ার মাধ্যমে তৈরি করে। পুকুরের জলে সেই খাদ্য উপাদান জোগানো সম্ভব হলে স্বাদে বড় পার্থক্য থাকবে না।
যদিও অর্থাভাবে গবেষণা প্রায় থমকে গেছে, বিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছের খাবার কিনে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মতে, পূর্ণ সাফল্য পেতে আরও ১০-১৫ বছরের অবিচ্ছিন্ন কাজ প্রয়োজন। তবে এ পর্যন্ত হওয়া অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। যদি প্রকল্প সম্পূর্ণ সাফল্য পায়, তবে আর বারোমাস নদী-সমুদ্রের অভিবাসনের উপর নির্ভর করতে হবে না। উৎসবের মৌসুমেই নয়, বছরের প্রতিটি সময়ে বাঙালির রান্নাঘরে পৌঁছতে পারে রূপালি ইলিশ।