আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতে স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ খরচ বহু পরিবারকে দারিদ্র্য, ঋণগ্রস্ততা ও চরম সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় প্রতিদিন নতুন নতুন করুণ ঘটনা সামনে আসছে—যা কেবল ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়, সংবিধান স্বীকৃত জীবনের অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।
উত্তর প্রদেশের হাপুরে গত ২০ জুন মাত্র পাঁচ বছরের এক কন্যাশিশু প্রাণ হারায়। অভিযোগ, বেসরকারি একটি হাসপাতাল অবিলম্বে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে না পারায় তার চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। শিশুটির বাবা-মা দিনমজুর। অর্থ না দিতে পারায় তারা মেয়েকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন।চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেঙ্গালুরুতে ৭২ বছর বয়সী এক ক্যান্সার রোগী আত্মহত্যা করেন। অভিযোগ, তিনি আয়ুষ্মান ভারত সরকারি বিমা প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত থাকলেও চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় জীবন বিসর্জন দেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসার খরচে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই এখন “out-of-pocket” অর্থাৎ পরিবারের নিজস্ব খরচ থেকে বহন করতে হয়। এর ফল—চিকিৎসা বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ঋণ নেওয়া, গয়না বিক্রি, এমনকি জমি বন্ধক রাখা। যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত হলে পরিবারের বার্ষিক আয়ের পাঁচভাগের একভাগ শেষ হয়ে যায় চিকিৎসা শুরুর আগেই। ক্যান্সার রোগীদের পরিবারকে গড়ে তিন লাখ টাকারও বেশি অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়।
যেখানে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলা হয়, সেখানেও রোগীদের অনানুষ্ঠানিক টাকা দিতে হয়। এতে গরিব মানুষ প্রায়ই ঋণী হয়ে পড়ে বা প্রয়োজনীয় ফলো-আপ চিকিৎসা বাদ দিয়ে দেয়। রোগ আরও জটিল হয়, মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে। চিকিৎসা খরচের ভয়ে বহু মানুষ ছোটখাটো উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নেন না। উচ্চ রক্তচাপ বা প্রাথমিক স্তরের যক্ষ্মার মতো রোগ সময়মতো ধরা পড়লে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু দেরিতে চিকিৎসা শুরু হওয়ায় তা জটিল হয়ে ওঠে এবং খরচও বহুগুণ বাড়ে। এতে বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
টিকা, গর্ভকালীন পরীক্ষা, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা—যা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার মূল হাতিয়ার—অনেকের নাগালের বাইরে। ফলে আগেই দমন করা রোগ ফের ছড়াচ্ছে, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারও কমছে না। উচ্চবর্ণের তুলনায় তফসিলি জনজাতির টিকাকরণের হার ২০ শতাংশ কম। গ্রামীণ শিশুদের টিকাকরণ শহরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। গরিব ও প্রান্তিক মানুষ প্রায়ই অযোগ্য ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট বা অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছে ভরসা করে। এতে ভুল রোগ নির্ণয়, অবৈধ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
দলিত, যৌন সংখ্যালঘু ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীরা বৈষম্য, ভাষাগত সমস্যা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় চিকিৎসা পেতে আরও বেশি বাধার সম্মুখীন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্বাস্থ্য সূচক জাতীয় গড়ের থেকে অনেক নিচে। ভারতের বিশাল অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে অসুস্থতায় ছুটি নেই, বেতন নেই। অসুস্থ হলে বা পরিবারের কারও যত্ন নিতে হলে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। আয় বন্ধ হলে সঞ্চয় ফুরিয়ে যায়, খাবারের মান খারাপ হয়, সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মানবসম্পদে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান, নিম্নমানের পরিষেবা বা অতিরিক্ত বিল—প্রতিটি ঘটনায় মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। অথচ ১৯৮৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছিল—স্বাস্থ্যসেবা জীবনের অধিকার থেকে আলাদা নয়। তা সত্ত্বেও আজও অগণিত মানুষ মৌলিক চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যকে বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রকে অবিলম্বে জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজন সচ্ছতা, জবাবদিহি ও সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ শক্তিশালী করা। যাতে কোনো নাগরিককে নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার ঝুঁকি নিতে না হয়।