‘এখানে দুর্গা প্রতিমা বিক্রি নেই!’ কুমোরটুলিতে আছে এমনও এক শিল্পীর ঘর
বর্তমান | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শুভদীপ রায়, কলকাতা; দুর্গাপুজোর আগে কুমোরটুলি যেন গোলকধাঁধা। গলিগুলো সব কেমন যেন একরকম। যেদিকে তাকাও দেবী দুর্গা অ্যান্ড ফ্যামিলি। সরু গলির ছোটো ছোটো ঘরগুলোয় ঠাসা বড়-ছোট-মাঝারি নানা মাপের প্রতিমা। দিনরাত এক করে মূর্তি গড়ার কাজে ব্যস্ত কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা। যত বেশি ঠাকুর বিক্রি, তত নিশ্চিন্তে কাটবে বাকি বছরটা। এই আশায় নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন অনেকেই। ব্যতিক্রম তপন পাল। কুমোরটুলিতেই থাকেন, মূর্তি তৈরিই পেশা, অথচ পুজোর আগে দুর্গামূর্তি গড়ার কোনও তাড়া নেই তাঁর।
বনমালী সরকার স্ট্রিট দিয়ে ঢুকে ডানদিকের প্রথম গলি। কয়েক পা এগোলেই কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সংগঠনের অফিস। তারই লাগোয়া একটা সরু ঘর। বাকি ঘরগুলোর সঙ্গে একটাই পার্থক্য, সামনে কোনও দুর্গা প্রতিমা নেই। এখানেই থাকেন ভাস্কর তপন পাল। আর্ট কলেজের ছাত্র। কলেজ পাস করে চলে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদ। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন রামোজি ফিল্ম সিটিতে। বছর পাঁচেক আগে শিকড়ের টানে কুমোরটুলিতে ফিরে আসা। মূর্তি গড়া বরাবরের নেশা। পারিবারিক সূত্রেই তা পেয়েছেন বলা যায়। ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে দুর্গা প্রতিমা গড়তেন। তবে এখন আর সেদিকে আগ্রহ নেই তপনবাবুর। কিন্তু কেন?
দুপুরের খাওয়া সেরে তখন ফল নিয়ে বসেছেন একজন। কুমোরটুলির অন্দরে এমন দৃশ্য খুব একটা পরিচিত নয়। বিশেষ করে দেবীপক্ষে। বাকি সব ঘরে এখন যুদ্ধকালীন ব্যস্ততা। একের পর এক প্রতিমা রওনা দিচ্ছে মণ্ডপের পথে। চিৎকার, হুল্লোড়ে গমগম করছে পটুয়াপাড়া। সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই তপনবাবুর। নিশ্চিন্তে ফল কাটতে কাটতে বললেন, ‘এখনকার দুর্গামূর্তি গুলো কেমন যেন বদলে গিয়েছে। দেখতে ভালো লাগে না। তাই বানাই না। তাছাড়া বয়স হয়েছে। একা হাতে এতকিছু সামলানো সম্ভব নয়।’ কথায় কথায় স্মৃতির সাগরে ডুব দিলেন। রমেশ পাল, গোরাচাঁদ পালের মতো শিল্পীদের নাম করে বললেন, ‘এঁদের তৈরি ঠাকুর মানুষ দাঁড়িয়ে দেখত। এখনকার দুর্গা দেখে মনে সেই ভক্তি জাগে না। ঠাকুরের কম্পোজিশন বদলে সব কেমন ছোটো করে দেওয়া হচ্ছে। বড় ঠাকুর হলেও তা যেন স্রেফ আকারেই বড়ো, রাজকীয় ছাপ নেই।’ তাহলে যত সমস্যা থিমের ঠাকুর নিয়ে? তাতেও আপত্তি তপনের। বললেন, ‘এই জগৎ মুখার্জি পার্কে আর্টের ঠাকুর বানাতেন অশোক গুপ্ত। আমরা তখন ছোটো। হাঁ করে দেখতাম সেই প্রতিমা। সেও তো আর্টের ঠাকুর।’
কথায় কথায় বোঝা গেল তপনবাবুর আক্ষেপ অন্য জায়গায়। তাঁর মতে, কুমোরটুলির ঠাকুরের নিজস্ব পরিচিতিটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ অতিরিক্ত লাভের আশায় প্রতিমা তৈরির ব্যাকরণটাই ভুলেছেন। তাদের নকল করছে আরও অনেকে। সেই গড্ডালিকায় গা ভাসাতে চান না তিনি। একাকী এই ভাস্করের কাছে তাহলে ভালো ঠাকুরের সংজ্ঞাটা ঠিক কেমন? তপনবাবুর ভণিতাহীন জবাব, ‘যে প্রতিমা দেখলেই হাতজোড় করতে ইচ্ছা হবে। ঠিক যেমনটা আগে হতো!’