অভিজিত্ চৌধুরী, চুঁচুড়া: শারদীয়া এলেই উমা আসেন স্কুলের ঘরে। ভুল লেখা হয়নি, একেবারেই ঠিকঠাক লেখা হয়েছে। স্কুলের ঘরেই আসেন উমা। বাঙালির সনাতন চেতনার সঙ্গে হয়তো মিলবে না। কিন্তু হুগলির পাণ্ডুয়ার গ্রামবৈঁচির স্কুলে আবির্ভূতা হন দেবী দশভুজা। ‘বৈঁচি বিহারীলাল মুখার্জ্জী ফ্রি ইনস্টিটিউশন’এ ষোড়শপচারে পুজো হয় দশভুজার। বাংলার একমাত্র পুজো যা সম্পূর্ণভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে হয় এবং এবারও হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামবৈঁচির সাবেক জমিদারদের ওই পুজোর বয়সের হিসেব তেমন মেলে না। তবে পুজো যে শতাব্দী প্রাচীন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ বিশেষ নেই। পাশাপাশি স্কুলে দেবীর আর্বিভূত হওয়ার বয়স প্রায় আশি ছুঁয়ে ফেলেছে। এক হিসেবে স্বাধীনতার সমসাময়িক বাংলার একমাত্র ‘স্কুলদুর্গা’।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরস্বতীর আপন ঘরে দশভুজার আরাধনা কেন? তার উত্তর খুঁজতে গেলে চলে যেতে হবে ইতিহাসের বিবর্ণ এক অধ্যায়ে। ইতিহাস বলে, অপুত্রক জমিদার বিহারীলাল স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উইল করেছিলেন। সেই পরামর্শ তাঁকে দিয়েছিলেন বাংলার শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জমিদারের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কমলেকামিনীদেবী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রয়াস করেছেন। ১৯০৫ সালে জমিদার গিন্নি কমলেকামিনীর মৃত্যুর পর তাঁর বসতবাড়িটি স্কুল হয়ে যায়। সেই বাড়ির দেব দেউলেই ছিলেন জমিদারবাড়ির সাবেক দশভুজা। বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দেবীরও হস্তান্তর ঘটে। পুজোর দায়িত্ব এসে পড়ে স্কুলেরই উপর। আর সাবেক জমিদারি পুজো পরিচিত হয়ে ওঠে এক বিরল নামে, ‘স্কুলদুর্গা’। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র অসিত মুখোপাধ্যায় জানেন সেসব ইতিহাসের কথা। প্রবীণ অসিতবাবু বলেন, ‘স্কুলের ভিতরেই দুর্গাদালান। আমরাও চেষ্টা করেছি লোকমুখে পরিচিত হয়ে যাওয়া ‘স্কুলদুর্গা’র পুজোকে ধরে রাখতে। স্কুলের পক্ষে দায় বহন কঠিন হলেও আজও পুজো চলছে। স্কুলের কর্তারা বছরের পর বছর নানাভাবে এক বিরল পুজোর ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন।’ বৈঁচি বিহারীলাল মুখার্জ্জী ফ্রি ইনস্টিটিউশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক পীয়ূষকান্তি ঘোষ বলেন, ‘আমি ২০১৮ সাল থেকে পুজোর আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। ভাবতে অদ্ভুত লাগে স্কুলে দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু এও এক ইতিহাস, তাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস স্কুলের প্রাক্তন, বর্তমান ছাত্র, শিক্ষক সকলেই করেন।’
বিরল সময়ের খেয়ালে শুরু হয়েছিল এক বিরল পুজো। জনশ্রুতির চমক এখানে তেমন নেই। আছে ইতিহাস, সময়ের ধারাকথন আর ‘স্কুলদুর্গা’। যিনি নিজেই চমক জাগিয়ে রাখেন। প্রয়াত জমিদার বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় উইল করে স্কুল স্থাপন করেছিলেন। একসময় ট্রাস্টের অধীনে থাকা স্কুলভবনের ভিতরের দুর্গা দালানে পুজোর চল ছিল। প্রয়াত জমিদারগিন্নি নিজের উইলে পুজোর জন্য ১০০০ টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। আজ হাজার টাকার অনুদান সময়ের গতিতেই তুচ্ছ হয়ে পড়েছে। হুগলির গ্রামবৈঁচী স্টেশনের খুব কাছেই স্কুলভবন। পুরনো তমসুকে লেখা ইতিহাসের মতোই বিবর্ণ হয়ে জেগে আছে প্রাচীন দেব দেউলের সাবেক গঠন। তাতে নতুন সময়ের টাইলস বসেছে। জৌলুস নয়, অন্য এক উজ্জ্বল আভা ঘিরেছে ‘স্কুলদুর্গা’কে। সে আভা ঐতিহ্যের আর ‘একমেব অদ্বিতীয়’ হওয়ার।