• দেশহীন মানুষের যন্ত্রণার দর্পণে ঋত্বিককে স্মরণ
    আনন্দবাজার | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • পথ হেঁটে চলেছেন দেশহীন মানুষেরা। একটি দেশের খোঁজে। একটু আশ্রয়ের খোঁজে। পূর্ববঙ্গে, সিরিয়ায়, সুদানে।

    দেশভাগ, গৃহযুদ্ধ-সহ নানা কারণে ছিন্নমূল হয়েছেন, হয়ে চলেছেন বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নাগরিক। দেশভাগের যন্ত্রণার, উদ্বাস্তু মানুষের লড়াইয়ের দলিল ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলি। কী ভাবে ভোলা যায় তাঁর ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতে নিজের ফেলে আসা জন্মভূমি পূর্ব বাংলার দিকে আঙুল তুলে ভৃগুর কণ্ঠে দলা পাকিয়ে ওঠা যন্ত্রণা, ‘ওই পারেই আমার দেশের বাড়ি। ওই যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। এত কাছে, অথচ কোনও দিন আমি ওখানে পৌঁছতে পারব না। ওটা বিদেশ।’ এ বছর পরিচালকের জন্মশতবর্ষ। এ বার তাই এই বিষয়গুলি তুলে ধরে ঋত্বিককে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বেহালার আদর্শপল্লির পুজো।

    এ বার এই পুজো পা দিচ্ছে ৬৮তম বর্ষে। থিম ‘আয় গো উমা কোলে লই।’ ঋত্বিকের ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’-কে কেন্দ্র করে সেজে উঠছে আদর্শপল্লির মাতৃবন্দনা। সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত এই ছায়াছবির মূল চরিত্র নীতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে উদ্বাস্তুদের জীবনযুদ্ধের কাহিনি। তাই গড়ে তোলা হয়েছে একটি উদ্বাস্তু কলোনি। সেই কলোনিতে ঢোকার মুখে হাতে আঁকা ঋত্বিকের ছবি। রয়েছে নীতার ছবিও। কলোনির দেওয়াল জুড়ে আঁকা দেশহীন মানুষদের অনন্ত যাত্রা। পুজোর শিল্পী শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, অভীক সেনরা বলছেন, ‘‘দেশ হারানোর বেদনা, উদ্বাস্তু মানুষের যন্ত্রণা, চোখের জলের কথাবলতে গেলে ঋত্বিকের কাছেই আমাদের হাত পেতে দাঁড়াতে হবে। তিনি তাঁর ছবিতে এই সব মানুষের কথাই বলেছেন।’’

    সিরিয়া, সুদানের শরণার্থীদের পাশাপাশি প্যালেস্টাইনের কথাও তুলে ধরা হচ্ছে এই পুজোয়। এই মুহূর্তে প্যালেস্টাইনের উপরে ইজরায়েলের আগ্রাসন, গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। ছড়িয়ে পড়ছে স্লোগান, ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি।’ শুভম, অভীকও বলছেন, ‘‘যে ভাবে ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে নরসংহার চালাচ্ছে, প্যালেস্টাইনবাসীদের উচ্ছেদ করে তাঁদের দেশহীন করে দিতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে আরও জোরালো প্রতিবাদ করা দরকার। সেই প্রতিবাদের হাতিয়ার ঋত্বিকের চিন্তা, ছবিগুলি। তাই ঋত্বিক আজও প্রাসঙ্গিক।’’ পুজোয় প্রতিমা গড়ছেন মিন্টু পাল। মণ্ডপে থাকবে নীতার ফাইবারের মূর্তিও।

    ঋত্বিকের জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সল্টলেকের এ কে ব্লক অ্যাসোসিয়েশনের পুজোও। ঋত্বিককে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে নারীশক্তির আরাধনায় মেতে উঠেছে তারা। পুজোর শিল্পী বিশ্বনাথ দে বলেন, ‘‘দুর্গা নারীশক্তির প্রতীক। ঋত্বিকের অনেক ছবির নারী চরিত্র, যেমন সীতা (সুবর্ণরেখা), নীতা (মেঘে ঢাকা তারা) অনুসূয়ার (কোমল গান্ধার) মধ্যেও সেই দেবীশক্তির প্রকাশ দেখাদেয়। বাঙালি সেই নারীশক্তিকেই আমাদের কুর্নিশ।’’

    ৩৮তম বর্ষের এই পুজোর থিম ‘যুক্তি আর তর্ক।’ পুজো মণ্ডপ সাজানো হচ্ছে ঋত্বিকের ‘নাগরিক’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’ ইত্যাদি ছবির হাতে আঁকা পোস্টারে। থাকছে পরিচালকের সৃষ্ট ছবি, তথ্যচিত্রএবং অসম্পূর্ণ ছবির তথ্য। কাঠে খোদাই করা শিল্পীর বিভিন্ন উক্তি। থাকছেন ঋত্বিক স্বয়ং, কাঠের মূর্তিতে। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ব্রত প্রামাণিকের কথায়, ‘‘ঋত্বিক ঘটকের চিন্তাভাবনা নিয়ে বড়হয়েছি। তাঁর ছবি আমাদের প্রভাবিত করেছে। আজও তিনি ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। ২০২৫-এও ঋত্বিককে তাই নতুন করে আবিষ্কার করা দরকার। বর্তমান জেন জ়ি প্রজন্মের কাছে ঋত্বিকের চিন্তাভাবনা বেশি করে তুলে ধরা দরকার।’’

    পুজোয় ঋত্বিক প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রবেত্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ঋত্বিক ঘটকের বাঙালিয়ানার যে সব ধরনের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এই দু’টি পুজোয় সেগুলি অনুকরণ করা হয়েছে।উনি যে একই সঙ্গে লৌকিকনারীকে অতিলৌকিক দুর্গা বাকালীর সঙ্গে একাকার করে দেন, সেটি ধরার চেষ্টা হয়েছে। ঋত্বিকমনে করতেন, পৌরাণিক কথা বা হিন্দুত্বের বাইরেও এক ধরনের দেবী গর্জন আমাদের নীচের তলার সমাজকে উজ্জীবিত করতে পারে। এক জন মার্ক্সবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়কে উপেক্ষা করেননি এবং সেগুলিকে খেয়াল করেছেন। আজ কেউ তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে এই কল্পনাগুলি ব্যবহার করলে তা অভিনন্দনযোগ্য।’’

    পুজোয় ঋত্বিককে নিয়ে ভাবছে বাঙালি। ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করতে বলে গিয়েছেন তো চলচ্চিত্রকারই।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)