পঞ্জিকায় দেবীর আগমন-গমনের বাহন হিসাবে উল্লেখ থাকে হাতি, ঘোড়া, নৌকা বা দোলার। কিন্তু মৃৎশিল্পীর ঘর থেকে ঠাকুরদালান বা মণ্ডপে প্রতিমা নিয়ে আসার জন্য তো সেই বাহনদের দেখা মেলে না। কুমোরটুলির সরু গলি থেকে আশ্চর্য দক্ষতায় বিশাল প্রতিমা বার করে এনে গাড়িতে তুলে দেন এক দল দক্ষ শ্রমিক। তাঁরাই আবার নিখুঁত ভাবে মূর্তি বসিয়ে দেন অপরিসর গলির ভিতরে মণ্ডপে।
বাড়ির পুজোর সোনালি যুগে শিল্পীরা বেশির ভাগ সময় ঠাকুরদালানেই তৈরি করতেন প্রতিমা। কুমোরটুলি থেকে মূর্তি নিয়ে আসার প্রয়োজন হলেও, পরিবারের মধ্যেই যথেষ্ট সংখ্যায় সমর্থ হাতের অভাব হত না। কিন্তু সর্বজনীন পুজোর যুগে প্রতিমার আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, সুরক্ষিত ভাবে মণ্ডপে প্রতিমা বহনের জন্য দরকার পড়ল দক্ষ ‘বাহক’দের প্রত্যক্ষ সহায়তা।
এই প্রয়োজনসূত্রেই ফি-বছর পুজোর মরসুমে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর-সহ দূরদূরান্ত থেকে মৃৎশিল্পীদের পাড়াগুলিতে সেই শ্রম-পরিষেবা দিতে, আসতে শুরু করেন এই ‘বিশেষ’ শ্রমিকরা। মহালয়ার আগে থেকে শুরু করে চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিনেও মণ্ডপ বা পুজোবাড়িতে প্রতিমা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন তাঁরা। এই ক’দিন তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই হয় কুমোরটুলির অস্থায়ী আস্তানায়। এর পর সারা শহর ঠাকুর দেখার জন্য যখন রাস্তায় নামে, সেই সময়টা তাঁদের ব্যস্ততার সাময়িক বিরতি। তখন ফুরসত মেলে নিজেদেরও টুকটাক শহর দেখার, পরিবারের জন্য টুকিটাকি কেনাকাটার। ভাসান-পর্বে ফের হাজির সেই চেনা মুখের সারি। তাঁদের সাহায্যে মণ্ডপ থেকে প্রতিমা নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায় গঙ্গার ঘাটে। সেখানে বিসর্জন দেওয়ামাত্রই আর এক দলকে দেখা যায় জল থেকে প্রতিমার কাঠামো তুলে আনতে। মাঝে পুরসভার তরফে এ কাজে ক্রেন ব্যবহার হচ্ছিল। কিন্তু দৃশ্যদূষণ ঠেকাতে ও সময় বাঁচাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই শ্রমিকদের।
বছরের অন্য সময়ে খেতমজুর বা ইটভাঁটার অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন তাঁরা। সুন্দরবন থেকে আসা শ্রমিকেরা চিংড়ি চাষের কাজ করেন। কিন্তু শরতের আকাশে আলোর বেণু বেজে উঠলে এঁদের অনেকেরই গন্তব্য হয় কলকাতা। বাবার হাত ধরে দুই দশক আগে প্রথম ঠাকুর তোলার কাজে আসার পর, কোভিডের সময়টুকু বাদে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই কাজ করে যাচ্ছেন, এমন মানুষের দেখাও মেলে কুমোরটুলিতে।
পুজোর সুষ্ঠু আয়োজন সম্পন্ন হয় এমন বহু মানুষের শ্রমের মূল্যেই। অথচ উৎসবের হুল্লোড়ে তাঁদের কথা চাপা পড়ে যায়। কেউ কেউ তবু ভাবেন ওঁদের নিয়ে— পাইকপাড়া অঞ্চলের দত্তবাগান দুর্গোৎসব কমিটি যেমন এ বছর তাদের পুজোর ৭২তম বর্ষে তুলে ধরেছে এই প্রতিমাবাহকদের কথাই, ‘বাহন’ শিরোনামে। মণ্ডপ সেজেছে কুমোরটুলির চেহারায়, প্রতিমা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন এক দল শ্রমিক (ছবি)— দেখতে পাবেন দর্শকেরা। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, পল্লব শেখর দাস, দীপঙ্কর দে ও ওঁদের সহযোগীরা আছেন নির্মাণ-নেপথ্যে, আবহ করেছে গানের দল ‘দোহার’। পুজো কমিটি সম্মাননায় ভূষিত করবেন কয়েকজন শ্রমিককে। একটু হলেও আলো পাবেন দুর্গোৎসবের এই উপেক্ষিত নায়কেরা।
ঘরের মেয়ে
ঠাকুরদালানের উচ্চকোটির স্থাপত্য, ঝাড়বাতির জৌলুস সরিয়ে রেখেও, ঐতিহ্যের নিরিখে উচ্চ পুরনো বহু পারিবারিক পুজো শহরময়। যেমন বাগবাজারে ভগিনী নিবেদিতার বাড়ির কাছে, ২০ নং বোসপাড়া লেনে ‘বৈকুণ্ঠ ধাম’-এর পুজো। পুজো শুরু করেন শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-লীলামৃত রচয়িতা বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল ও তাঁর চার পুত্র; অন্যতম পুত্র, বিজ্ঞানসাধক চিকিৎসক সুধীরনাথ সান্যাল ভারতে ক্যানসার-গবেষণায় অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯১৮-য় শ্রীমা সারদা দেবীর উপস্থিতিতে ও তাঁর নামে সঙ্কল্প করে শুরু হওয়া এ পুজোর পৌরোহিত্য করেন উত্তরকালে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু স্বামী ভূতেশানন্দ। পরিবারের সদস্য শিবাজী সান্যাল জানালেন, এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে (ছবি) পূজিতা, গণেশ কার্তিক লক্ষ্মী সরস্বতীর পুজো হয় ঘটে। দেবী দাঁত মাজবেন মুখ ধোবেন বলে এ বাড়িতে দেওয়া হয় বেলকাঠ ও ঈষদুষ্ণ জল, চা দেওয়া হয় রুপোর কাপ-ডিশে। ঠিক যেন বাপের বাড়িতে আসা মেয়েটির আদর!
শিকড় ছুঁয়ে
কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে, ২০১৯ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারে ব্রতী ‘বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইড’। তার পরের বছর থেকেই তারা শুরু করেছে শারদীয়া পত্রিকা, মা তোর মুখের বাণী। গত বছর এই ডিজিটাল শারদীয়া সঙ্কলন ডাউনলোড করে পড়েছিলেন ১২০টি দেশের বাঙালিরা। এ বারের পুজোসংখ্যা সেজেছে গল্প কবিতা প্রবন্ধ ভ্রমণকথায়— ১২টি দেশ থেকে ১০৬ জন লেখক লিখেছেন। শুধুই এক পত্রিকা নয়: বাংলা সাহিত্য, বাঙালির ঐতিহ্যকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার, ঘরে-বাইরে বাঙালিদের এক তারে বেঁধে শিকড় ছুঁয়ে থাকারও চেষ্টা।
ভোগ-বৈচিত্র
পুজোর ক’দিন রোজ থাকবেই: সাদা ভাত, খিচুড়ি, সাত রকম ভাজা, বেগুনি, শুক্তো, ডাল, নিরামিষ তরকারি, আলু-পটলের কালিয়া, পোনামাছ, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। এহ বাহ্য, নৈবেদ্যে রোজ থাকে কিছু বিশেষ পদের আয়োজন: সপ্তমীতে লাউ-চিংড়ি, অষ্টমীতে শাকের ঘণ্ট, নবমীতে ভেটকি মাছের ঘণ্ট, পোলাও। মাছ, নানা ভাজা-সহ চোদ্দো থালায় দেওয়া হয় অন্ন ও খিচুড়ি ভোগ। দশমীর দিন অরন্ধন: আগের দিন রান্না করে রাখা পদ সে দিন নিবেদিত হয়, থাকে ছাঁচিকুমড়ো, ইলিশের অম্বল। ভোগের এই বৈচিত্র অন্যতম বৈশিষ্ট্য— ১২০ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোয়, জানালেন বাড়ির প্রবীণ সদস্য গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। গৃহের নাম ‘রামচন্দ্র ভবন’; ১৮৬০-এ শুরু হওয়া পুজো ১৬৬ বছরে পড়ল। পারিবারিক প্রথা মেনে, ভোগ রান্না করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যেরা।
উত্তরাধিকার
লেকটাউন গ্রিন পার্কের বাড়িতে ভৌমিক পরিবার যে দুর্গাপুজো করে আসছেন তার শিকড় ১৯২৭ সালে, পূর্ববঙ্গের নোয়াখালির জয়াগ গ্রামে। সাধারণ আর্থিক সঙ্গতির এক বাঙালি চন্দ্রকান্ত ভৌমিক: এক জীবনে মিলিয়েছিলেন ডাকঘরের চাকরি, শখের যাত্রা, শিক্ষকতা, ভ্রমণ, লেখালিখি। শেষোক্ত কৃতির প্রমাণ তাঁর লেখা নানা বই: পাঁচালি, তীর্থ-মাহাত্ম্য বিষয়ক, আবার ত্রিপুরার ভূগোল, বঙ্গীয় ও অসমের ঋণ সালিশি বোর্ডের আইন নিয়েও। আশার কথা, ওঁর শুরু করা পুজোর ধারা যেমন বহতা কলকাতায়, তেমনই উত্তরসূরি অমিত, শেখর ও অভিষেক ভৌমিক পিতামহের লেখালিখির একটি সঙ্কলনগ্রন্থও প্রকাশ করেছেন স্ব-উদ্যোগে। পারিবারিক ও আঞ্চলিক, দুই ইতিহাসেরই জরুরি উপাত্ত।
পরিবেশ-বন্ধু
মেয়ের চোখ আঁকা হয়েছে জলের দাগে। শিল্পী ভবতোষ সুতার জানেন, সে চোখ যারা দেখার ঠিক দেখে নেবে। নজরুল, তারাশঙ্করের স্মৃতি ঘেরা, একদা ‘সাহিত্যিকদের পাড়া’ বলে খ্যাত অঞ্চলের পুজো ‘টালা প্রত্যয়’। শতবর্ষে এ বার একটি লোকের ভাবনা-সমুদ্দুরকে সে ছুঁতে চেয়েছে। সব ছেড়ে শুধু পুজোর মাঠেই নিজের মেধা, ঘাম নিংড়ে দিয়েছেন ভবতোষও। শুধুই মাটি, বাঁশ, তুষ, কাপড়ের পরিবেশবান্ধব আঙ্গিক। কৃত্রিম রংহীন, নিরাভরণ তা। বিশাল কন্যামূর্তির চোখের মণির আপাতশূন্যতা যেন মাটির বুকের লুপ্তপ্রায় সব শস্যবীজের অস্তিত্ব খুঁজে চলেছে। আদ্যন্ত রাজনৈতিক একটি পুজো-বিনির্মাণ— মুনাফার বীজগণিতে ভবিষ্যতের খাদ্যসঙ্কট নিয়ে সতর্ক করছে যেন। আজকের দুর্গাপুজো-শিল্পের প্রধান ধারক-বাহক এই পুজো শিল্পরসিক-মহলে মহানগরের বিশিষ্ট এক কণ্ঠস্বর।
গল্পের ছবি
মহালয়ার দিন উদ্বোধন কার্যালয় থেকে বেরোয় নতুন ইংরেজি বছরের বর্ষপঞ্জি তথা ক্যালেন্ডার-বই। চলতি বছর ফুরনোর ঢের আগেই, তবে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকানুসারী এই বর্ষপঞ্জি আগেভাগে হাতে পেলে কাজেও দেয় বিস্তর। ২০২৬-এর বিষয় ‘শ্রীরামকৃষ্ণ গল্পকথা’। বেদ বেদান্ত ষড়দর্শনের সার গল্পের ভাষায় সাধারণ্যে সহজবোধ্য করে দিতেন শ্রীরামকৃষ্ণ, তাঁর বলা কয়েকটি গল্পের চিত্ররূপ বর্ষপঞ্জির পাতায় পাতায়: বদ্ধজীবের উপমাস্বরূপ জেলের ‘ডাঙায় মাছ টেনে তোলা’ (ছবি) বা মুমূর্ষুর মৃত্যুশয্যায় শুয়েও ‘প্রদীপে অত সলতে কেন?’, সংসারীর নির্জনে সাধন প্রসঙ্গে ‘চারাগাছে বেড়া দেওয়া’, লোকব্যবহারের উপমাস্বরূপ ‘মাহুত নারায়ণ’ ইত্যাদি। চিত্রশিল্পী রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তী— শ্রীরামকৃষ্ণ চিত্রকথা, সারদাদেবী চিত্রকথা, শিশুদের বিবেকানন্দ-র মতো বইয়ে যাঁর আঁকা ছবিতে মুগ্ধ কয়েক প্রজন্ম।
জন্মশতবর্ষে
২৫ অক্টোবর তৃপ্তি মিত্রের জন্মশতবর্ষ, তাঁকে কেন্দ্রে রেখে বহুরূপী পত্রিকার ১৩৭তম সংখ্যা প্রকাশ পেল। ‘বহুরূপী’র ছেঁড়া তার, চার অধ্যায়, দশচক্র, রক্তকরবী, ডাকঘর, পুতুল খেলা, বিসর্জন, রাজা, রাজা অয়দিপাউস, বাকি ইতিহাস, অপরাজিতা, চোপ্ আদালত চলছে-র মতো স্মরণীয় নাটকে কেন্দ্রীয় নারীচরিত্রে তাঁর অভিনয় কে ভুলবে! তাঁর প্রয়াণের পর ১৯৮৯-এ এই নাট্যপত্রের ৭২তম সংখ্যার প্রথম অংশটি তৎকালীন সম্পাদক কুমার রায় উৎসর্গ করেছিলেন তৃপ্তি মিত্রকেই। বর্তমান সম্পাদক অংশুমান ভৌমিক জানালেন, সেখান থেকে খালেদ চৌধুরী অশোক সেন কমলা সিংহ ও অশোক মজুমদারের লেখা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, সঙ্গে রয়েছে বিভাস চক্রবর্তী ফেরদৌসী মজুমদার অশোককুমার মুখোপাধ্যায় সৌমিত্র বসু বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত তূর্ণা দাশ মল্লারিকা সিংহ রায়ের লেখা; নতুন একগুচ্ছ নাটকও। ছবি, পত্রিকা-প্রচ্ছদ থেকে।
নতুন বই
ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ভারতে আসেন ১৯৫৬-য়। কলকাতা পুদুচেরি দিল্লিতে থাকতেন, মন পড়ে ছিল বাংলা সাহিত্য-গবেষণায়। ’৭৮-এ ফিরে যান ফ্রান্সে। তাঁর চর্চার আর একটি পরিসর বাংলার উনিশ শতক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ফরাসি ভাষায় তাঁর বই প্রকাশিত হয় একুশ শতকের সূচনা-দশকেই। রামমোহন থেকে বঙ্কিমচন্দ্র অবধি তাঁর মনন-পর্যটন, বিদ্যাসাগরকে নিয়েও ইংরেজিতে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ বেরিয়েছে। শেষোক্ত বইটিই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে বেরোল বাংলা অনুবাদে— পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ঐতিহ্যে, আধুনিকতায়, আধুনিক মানবতাবাদের সেবায় নিবেদিত পরম্পরা—গতকাল বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে প্রকাশ করলেন ব্রাত্য বসু। তাঁরই সম্পাদনায়, বিদ্যাসাগর আকাদেমির উদ্যোগে প্রকাশিত হল একটি গল্প-সঙ্কলনও: গল্পে গল্পে বিদ্যাসাগর।