দেবী চৌধুরাণী কি বাস্তবের চরিত্র? নাকি তিনি শুধুই জনশ্রুতি? সত্যিই কি তিনি ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ করতেন, নাকি ছিলেন প্রজাহিতৈষী ‘জমিদার’? এসব নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। অবশ্য শুধু ইতিহাস নিয়ে মানুষ আর কবে মাথা ঘামিয়েছে? আজও জলপাইগুড়ির শিকারপুরের মন্দিরে ‘দেবী’ হিসেবে পূজিত হন তিনি। আর সাহিত্যে দেবী চৌধুরাণীকে বাঙালির জনমানসে চিরস্থায়ী করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসকে ভিত্তি করেই এবারের দুর্গাপুজোয় মুক্তি পেল ‘দেবী চৌধুরাণী’। পরিচালনায় শুভ্রজিত্ মিত্র। তবে তিনি শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসকে অনুসরণ করেননি। সঙ্গে যোগ করেছেন, ইংরেজদের নথিতে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য। ছবিতে মিশেছে বিভিন্ন জনশ্রুতিও। সাহিত্য-ইতিহাস ও জনশ্রুতির মেলবন্ধনে যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছেন দেবী চৌধুরাণী।
গল্পের প্রেক্ষাপট বাংলার সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর ইংরেজ শাসনের বিলোপ ঘটাতে ধর্ম ভুলে হাত ধরেছিলেন সন্ন্যাসী ও ফকিররা। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে বড় অংশ জুড়ে ছিল দেবী চৌধুরাণীর প্রথম জীবন অর্থাৎ প্রফুল্লের কাহিনি। তবে, শুভ্রজিত্ জোর দিয়েছেন প্রফুল্লের (শ্রাবন্তী) দেবী চৌধুরাণী হয়ে ওঠার যাত্রার উপর। গুরু ভবানীচরণ পাঠক (প্রসেনজিত্) কীভাবে তাঁকে বিদ্রোহীদের প্রধান হিসেবে গড়ে তুলেছেন, ছবিতে যত্ন করে দেখিয়েছেন পরিচালক। ইংরেজদের সঙ্গে দেবীর লড়াইও সিনেম্যাটিক ভাষা পেয়েছে। বাংলা সিনেমার ফাইট সিকোয়েন্স নিয়ে বারবারই অভিযোগ ওঠে। এই ছবি আপনাকে সেই অভিযোগের সুযোগ দেবে না। শ্রাবন্তীকে এতদিন মূলত রোমান্টিক নায়িকা হিসেবেই দেখেছেন দর্শক। তাঁর অ্যাকশন দৃশ্য দেখে চমকে উঠতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বহুবার দেখা গিয়েছে, দক্ষিণের অনুকরণে বাংলা সিনেমাতেও ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ দৃশ্য বা চরিত্র তৈরি করতে চেয়েছেন পরিচালকরা। কিন্তু তাতে বাস্তব থেকে সরে গিয়েছে গল্প। এই ছবিতে তেমন কয়েকটি দৃশ্য থাকলেও তা মাত্রা ছাড়ায় নি।
গ্রামের মেয়ে প্রফুল্ল থেকে বিদ্রোহীদের প্রধান হয়ে ওঠার জার্নিতে শ্রাবন্তী সাবলীল। খোলা চুলে কপালে রক্ততিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে তিনি যখন ইংরেজ বাহিনীকে দমন করতে যান, সত্যিই তাঁকে ‘দেবী’ মনে হয়। সবথেকে প্রশংসনীয়, চরিত্রকে রক্তমাংসের তৈরি করেছেন পরিচালক। ভবানী পাঠকের ভূমিকায় প্রসেনজিত্ ছাড়া অন্য কাউকে ভাবা অসম্ভব। উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ করেছেন। পাল্লা দিয়ে ত্রিশূল হাতে অ্যাকশনও করেছেন। রঙ্গরাজের ভূমিকায় অর্জুন চক্রবর্তী ও নিশির ভূমিকায় বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। সব্যসাচী চক্রবর্তী, দর্শনা বণিক যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, সেরাটুকুই দিয়েছেন। বিক্রম ঘোষের আবহসঙ্গীত এই ছবির সম্পদ। এই ছবির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জঙ্গলের দৃশ্য। সিনেমাটোগ্রাফার অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ক্যামেরা একবারের জন্যও জঙ্গলকে একঘেয়ে হতে দেয় না। সম্পাদনার জন্য প্রশংসা প্রাপ্য সুজয় দত্তরায়েরও।
অনুযোগ শুধু দুটি বিষয় নিয়ে। দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের মূল কার্যকলাপ ছিল বর্তমান রংপুর, জলপাইগুড়ি সহ বরেন্দ্র ভূমিজুড়ে। সেখানে লালমাটির পাহাড় একটু চোখে লাগে। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে শুদ্ধ বাংলাও একটু বেখাপ্পা।