লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনের নেতা সোনম ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি, যোধপুরে জেল...
আজকাল | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: লাদাখের জনপ্রিয় পরিবেশ আন্দোলনের মুখপাত্র, শিক্ষাবিদ ও উদ্ভাবক সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএ) জারি করেছে কেন্দ্র সরকার। শুক্রবার গভীর রাতে লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসন এক প্রেস বিবৃতিতে জানায়, সাম্প্রতিক লেহ-এ হিংসার জন্য ওয়াংচুক দায়ী এবং তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য “হুমকি”। তাকে দ্রুত জোধপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে, যাতে লাদাখের ভেতরে তাঁর প্রতি জনপ্রিয় সমর্থন সংগঠিত না হতে পারে।
প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে— “বারবার দেখা গেছে, শ্রী সোনম ওয়াংচুক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার পরিপন্থী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছেন।”
প্রশাসনের দাবি, ওয়াংচুকের ধারাবাহিক উস্কানিমূলক ভাষণ, আরব বসন্ত ও নেপালের আন্দোলনের উদাহরণ টেনে আনা, এবং তাঁর “ভ্রান্তিকর ভিডিও”র কারণেই গত ২৪ সেপ্টেম্বর লেহ-এ ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনায় সরকারি দপ্তর, প্রশাসনিক ভবন, স্কুল-কলেজের যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পুলিশের উপর হামলায় অন্তত চারজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঘটে।
লাদাখের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবি জানিয়ে আসছে, বিশেষ করে ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় লাদাখকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি। এই দাবির অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ওয়াংচুক একাধিকবার অনশন ধর্মঘট করেছেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের দাবিকে তুলে ধরেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, “পরিবেশগতভাবে ভঙ্গুর লাদাখকে শিল্পপুঁজির শোষণ থেকে রক্ষা করতে সাংবিধানিক সুরক্ষা অপরিহার্য।” কিন্তু প্রশাসনের অভিযোগ, আলোচনার প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অনশন ভাঙেননি এবং আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে, কাউকে সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে আটক রাখা যায়, এবং সরকারের গঠিত উপদেষ্টা বোর্ড অনুমোদন দিলে এই সময়সীমা আরও বাড়ানো সম্ভব। সমালোচকরা মনে করছেন, এই আইন ব্যবহার করে সরকার আসলে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলিও বলছে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ বা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিকে এক করা গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী।
ওয়াংচুককে আটক করার একদিন আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাঁর প্রতিষ্ঠিত এনজিও স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ (SECMOL)-এর এফসিআরএ (Foreign Contribution Regulation Act) লাইসেন্স বাতিল করে। প্রধান অভিযোগ ছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরে এনজিওটি ৪.৯৩ লক্ষ টাকা বিদেশি অনুদান পেয়েছিল “খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিয়ে সচেতনতা” কর্মসূচির জন্য। কিন্তু মন্ত্রক সেটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে “ভারতের সার্বভৌমত্ব নিয়ে গবেষণা” হিসেবে ব্যাখ্যা করে এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে চিহ্নিত করে।
তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সাকেত গোখলে এক্স-এ লিখেছেন: “খাদ্য সার্বভৌমত্ব” শব্দটিকে মন্ত্রক বিকৃত করে “ভারতের সার্বভৌমত্ব নিয়ে গবেষণা” বলেছে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ।” তিনি বলেন, এই শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক কৃষক সংগঠন ভিয়া ক্যাম্পেসিনা ১৯৯৬ সালে, যা জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রহণ করেছে। অথচ মোদি সরকার এটিকে বিকৃত করে ওয়াংচুককে লক্ষ্যবস্তু করছে।
মন্ত্রক SECMOL-এর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনে—পুরনো একটি বাস বিক্রি করে প্রাপ্ত ৩.৫ লক্ষ টাকা ভুলবশত এফসিআরএ অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া। ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে তিনটি ছোট অনুদান (১৮,২০০ টাকা করে) ভুল অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া। আইআইএম ইন্দোরের গবেষক মেঘা সাংঘভীর কাছ থেকে প্রাপ্ত ১৯,৬০০ টাকা ফেরত দেওয়া, যা মন্ত্রকের মতে আইনভঙ্গ। এসবকেই ভিত্তি করে মন্ত্রক এনজিওর লাইসেন্স বাতিল করে।
ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারি ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের ঘটনাকে বিরোধীরা একে সরাসরি গণআন্দোলন দমনের কৌশল বলছে। লাদাখের স্থানীয় মানুষও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, একজন শান্তিপূর্ণ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে সরকার আসলে জনগণের সাংবিধানিক দাবিকে অগ্রাহ্য করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লাদাখের মতো সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের স্বর দমন করা হলে তা শুধু গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত করবে না, বরং কেন্দ্রীয় শাসনের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলবে।