বরাভয় মুদ্রায় নবদ্বীপের দুর্গা মা অভয়া, এক হাতে বালকরূপী শিব
বর্তমান | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদদাতা, নবদ্বীপ: সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজও ব্যতিক্রমী দুর্গা আরাধনায় মাতোয়ারা হয় নবদ্বীপ ধামের নেতাজী সুভাষ রোডের পাঁচ মাথার দক্ষিণ অঞ্চল। এখানে দশভুজার আর এক নাম ‘মা অভয়া’। তাই এই জায়গা ‘অভয়া মা তলা’ নামেই খ্যাত।
আনুমানিক ২৭৩ বছর আগে মাটি খুঁড়তে গিয়ে মিলেছিল একটি ছোট ধাতব মূর্তি। সম্ভবত, এখনও পর্যন্ত নদীয়ায় প্রাপ্ত ধাতুমূর্তিগুলির মধ্যে এটিই ক্ষুদ্রতম। মূর্তির দৈর্ঘ্য ৭ সেন্টিমিটার ও প্রস্থ ৩.৫ সেন্টিমিটার। দেবী এখানে দ্বিভুজা। তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট। দেবীর ডান পায়ের উপর বাম পা স্থাপিত। ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা। বাঁ হাতে কোনও বস্তুর ভগ্নাংশ ধরে রয়েছেন দেবী। পিছনে নক্সা যুক্ত চালি। দেবীর পাদদেশে সরীসৃপ জাতীয় এক বস্তুকে বিশেষজ্ঞরা গোধিকা বলে অনুমান করেন। মূর্তিটি পাওয়ার পর তৎকালীন পণ্ডিত সমাজ শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় ধাতব মূর্তির প্রায় অনুরূপ একটি মৃন্ময় মূর্তি তৈরি করে অভয়া দুর্গার ধ্যানে পুজোর বিধান দেন। সেই থেকে অভয়া মা তলায় এক সাধারণ দালানে মন্দিরে পুরুষানুক্রমে দুর্গাপুজোর সময় এই দেবীর পুজো হয়ে আসছে। খুঁজে পাওয়া ধাতব মূর্তির পুজো পুরোহিত প্রয়াত খোকন মুখোপাধ্যায়ের রামসীতা পাড়া অঞ্চলের বাড়িতে বছরভর হয়। দুর্গাপুজোর সময় অভয়া মা তলার দালান মন্দিরে মৃন্ময়ী মূর্তির সঙ্গেই পুজো হয় এই ধাতব মূর্তিরও। নবদ্বীপের যে জায়গা থেকে মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল, সেখানেই ওই মন্দিরের অবস্থান ।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের মতে, আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ওই মূর্তি পাওয়া যায়। চৈতন্যদেবের সময়কালে গঙ্গার প্রাচীন শাখা এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হতো। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই শাখায় যে নৌকা চলেছে, চণ্ডীমঙ্গলে তার উল্লেখও পাওয়া যায়। এর পরিত্যক্ত খাত আজও এই অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গত, মৃন্ময় মূর্তিতে দেবী সিংহাসনে উপবিষ্ট ষোড়শী হেমাঙ্গী। ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা। বাঁ হাত একটি উলঙ্গ বালকের হাত ধরা। দেবীর কোনও বাহন নেই। পণ্ডিতরা ওই বালককে অভয়া মা ধ্যানে শিবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পুরাণমতে, অসুর দমনের পর দুর্গা বা ভগবতী দেবতাদের স্বস্তি দিতে অভয়া মূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছিলেন। এখানে ডান হাতের বরাভয় মুদ্রার জন্যে এই মূর্তির অভয়া নামকরণ করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। সম্প্রতি নিত্যপুজোর জন্য ওই ধাতব মূর্তির আদলে পাথরের তৈরি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বর্তমানে এই মন্দিরটি নবদ্বীপ শহরের হেরিটেজ তালিকাভুক্ত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা কুন্তী দাস বলেন, আমাদের এই দেবী খুবই জাগ্রত। অভয়া দেবী মা সব কিছুই দিয়েছেন আমাদের। অষ্টমীতে এই দেবীর কাছে পুজো দিতে রাত দু’টো থেকে লাইন পড়ে। নবদ্বীপ সহ দূরদূরান্ত থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার পুণ্যার্থী পুজো দেন। সেবাইত বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় জানান, অভয়া দেবী দ্বিভুজা। বালকরূপী শিবকে মা ধরে আছেন। কথিত আছে, ভগবতী যখন ধ্যান করছিলেন সেই সময় ধ্যান ভঙ্গ করার নানান চেষ্টা করছিলেন মহাদেব। কিছুতেই ভগবতীর ধ্যান ভঙ্গ করতে পারছিলেন না। সেই সময় শিব বালক রূপে গিয়ে দেবীর কাছে দাঁড়ান। শিব যাতে পালিয়ে না যায়, সেজন্য দেবী তাঁকে বা হাতে ধরে ডান হাতে অভয় দিচ্ছেন। সেজন্যই তিনি অভয়া মা।